২০০০ সালের শুরুতে বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বাযুদূষণ প্রকট আকার ধারণ করে। দ্রুত নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং যানবাহনের সংখ্যা বাড়ায় এ সংকট তৈরি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল বহুল ব্যবহৃত দুই-স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত ‘বেবি-ট্যাক্সি’ বা তিন চাকার ছোট অটোরিকশা, যা বাতাসে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ত।
দুই-স্ট্রোক ইঞ্জিন তুলনামূলকভাবে অকার্যকর হওয়ায় জ্বালানি সম্পূর্ণভাবে পোড়ে না এবং এর ফলে বাতাসে উচ্চমাত্রায় পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম), হাইড্রোকার্বন, কার্বন মনোক্সাইড ও সিসার মতো ক্ষতিকর উপাদান ছড়িয়ে পড়ত। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব ছিল গুরুতর।
২০০১–২০০৬ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে খালেদা জিয়া এসব দূষণকারী বেবি-ট্যাক্সি নিষিদ্ধের উদ্যোগ নেন। এটি বাংলাদেশের পরিবেশ নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি: কেন নিষেধাজ্ঞা জরুরি ছিল
দুই-স্ট্রোক বেবি-ট্যাক্সির ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে গবেষণায় উঠে আসে। এই ইঞ্জিনে জ্বালানি ও লুব্রিক্যান্ট একসঙ্গে মেশানো হয়, ফলে জ্বলন অসম্পূর্ণ থাকে এবং বাতাসে অপরিশোধিত হাইড্রোকার্বন ও সূক্ষ্ম কণিকা নির্গত হয়। ২০০০ সালের শুরুর দিকে ঢাকায় মোট যানবাহন চলাচলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছিল এই বেবি-ট্যাক্সি।
অতিরিক্ত খনিজ তেল ব্যবহারের কারণে (প্রস্তাবিত ৩ শতাংশের বদলে প্রায় ৮ শতাংশ) দূষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। গবেষণায় প্রতি কিলোমিটারে গড়ে শূন্য দশমিক ১৯ গ্রাম পার্টিকুলেট নির্গমন ধরা হয়। এতে ঢাকার বাতাসে পিএম মাত্রা আন্তর্জাতিক মানের দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে ১২৩ ইউজি/এম৩-এ পৌঁছায়।
এ দূষণ মানুষের শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশ করে ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা এবং অকালমৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি করে। শুধু পিএম১০-এর উচ্চমাত্রার কারণেই বছরে প্রায় ৬ হাজার অকালমৃত্যু এবং ৫০ হাজার দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিসের ঘটনা ঘটত বলে অনুমান করা হয়।
বেবি-ট্যাক্সি চালকরাও স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হতেন। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, প্রতি মাসে গড়ে সাত দিন অসুস্থতার কারণে তারা কাজ করতে পারতেন না। তাদের মধ্যে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে আসা, উচ্চ রক্তচাপ এবং শ্বাসকষ্ট সাধারণ ছিল। শিশুদের মধ্যে সিসা দূষণের ঝুঁকি ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় তিনগুণ, যা স্নায়ুতন্ত্র ও মেধার বিকাশে গুরুতর ক্ষতি করে।
এই পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত সংকটই খালেদা জিয়াকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। তাঁর সরকার সরাসরি দুই-স্ট্রোক বেবি-ট্যাক্সি নিষিদ্ধ করে।
ঐতিহাসিক পরিবেশ নীতি
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার দুই-স্ট্রোক বেবি-ট্যাক্সি ধাপে ধাপে বন্ধের জন্য একটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করে। এতে পরিবেশ রক্ষা ও জনস্বার্থের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। নব্বইয়ের দশকের শেষে সচেতনতামূলক প্রচারণা এবং পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে কাজটি শুরু হয়। তবে ২০০১ সালের অক্টোবরে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর প্রচেষ্টা গতি পায়।
সরকার বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে এনার্জি সেক্টর ম্যানেজমেন্ট অ্যাসিসট্যান্স প্রোগ্রামের (ইএসএমএপি) মাধ্যমে কাজ করে। ২০০০ ও ২০০১ সালে পরিচালিত অটো-ক্লিনিকগুলোতে চালকদের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও লুব্রিক্যান্ট ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশেষায়িত ২টি অয়েল ব্যবহারে নির্গমন ৬১ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব হয়। এ ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন দুই-স্ট্রোক ইঞ্জিনের জন্য মিনারেল অয়েল বিক্রি নিষিদ্ধ করে এবং এপিআই টিসি বা জেএএসও এফবি মানদণ্ড প্রয়োগ করে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি নেওয়া হয় ২০০২-২০০৩ সময়কালে। খালেদা জিয়ার প্রশাসন ঢাকায় দুই-স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত যান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। ২০০৩-০৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে সরকার স্পষ্ট জানায়, এই যানগুলো বায়ুদূষণের প্রধান উৎস এবং সেগুলোকে পরিষ্কার জ্বালানিতে চালিত চার-স্ট্রোক সিএনজি অটোরিকশা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে।
নীতি বাস্তবায়নের সময় চালক সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। জরিপে ৮৮ শতাংশ চালক বিকল্প পেশা বা সাধারণ ট্যাক্সি চালানোর সুযোগ পাওয়া সাপেক্ষে খালেদা জিয়ার পদক্ষেপকে সমর্থন করেন। পরিবেশ অধিদপ্তর নির্গমন মানদণ্ড হালনাগাদ করে এবং সিএনজি অবকাঠামো সম্প্রসারণে পদক্ষেপ নেয়, যাতে রূপান্তর প্রক্রিয়া মসৃণ হয়।
এই কৌশলকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা ‘কম্যান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল’ নীতির কার্যকর প্রয়োগ হিসেবে উল্লেখ করেন।
বেবি ট্যাক্সির ওপর নিষেধাজ্ঞার পরিবেশগত প্রভাব ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট। নিষেধাজ্ঞার পর ঢাকার বাতাসে ভাসমান কণিকার মাত্রা—বিশেষ করে পিএম১০ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২৪ ইউজি/এম৩ কমে যায়। সামগ্রিক বায়ুদূষণ প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়, যা মূলত দুই-স্ট্রোক ইঞ্জিনের নির্গমন বন্ধ হওয়ার ফল। চার-স্ট্রোক সিএনজি চালিত অটোরিকশা তুলনামূলকভাবে অনেক কম পিএম, হাইড্রোকার্বন ও কার্বন নির্গমন করে।
যদিও পরবর্তী সময়ে ডিজেলচালিত যান বৃদ্ধির মতো চ্যালেঞ্জ কিছু সুবিধাকে আংশিকভাবে কমিয়ে দেয়, তবুও স্বল্পমেয়াদে বায়ুর মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং লুব্রিক্যান্ট ব্যবস্থাপনার ফলে যানবাহনের ধোঁয়া নির্গমন ৪১ শতাংশ থেকে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব হয়েছিল। ফলে শুধু স্থানীয় বায়ুদূষণই কমেনি, জীবাশ্ম জ্বালানির অদক্ষ ব্যবহারও কমে, যা জলবায়ু লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।
এই নীতি বাংলাদেশে টেকসই শহুরে পরিবহন ব্যবস্থার উদাহরণ তৈরি করে। পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য শহরও একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা বিবেচনা করে। খালেদা জিয়ার এই উদ্যোগ বাংলাদেশকে উচ্চ-নির্গমন যান ধীরে ধীরে বন্ধের বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলে।
পরিবেশ রক্ষা থেকে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন
পরিবেশগত সুফলের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত উন্নতি, যা সরাসরি প্রভাব ফেলেছিল লাখো নগরবাসী ও পরিবহন শ্রমিকের জীবনে। বায়ুদূষণ কমে যাওয়ায় ঢাকায় শ্বাসকষ্টজনিত রোগের হার কমে যায়। একই সঙ্গে শিশুদে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতিও কমতে দেখা যায়। অন্যদিকে বেবি ট্যাক্সি চালকদের অসুস্থতা কমে এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা উন্নত হয়। পিএম মাত্রা কমে যাওয়ায় দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিস ও অ্যাজমার প্রকোপও হ্রাস পায়।
শহরের সাধারণ মানুষও এ সুবিধা লাভ করে। দূষণ-সম্পর্কিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও অকালমৃত্যুর হার কমে আসে। জরিপে দেখা যায়, ৯৭ শতাংশ চালক দুই-স্ট্রোক যানবাহনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। নিষেধাজ্ঞা–পরবর্তী জনসচেতনতা কর্মসূচি তাদের আরও সতর্ক করে এবং পরিচ্ছন্ন বায়ুর গুরুত্বজনিত ধারণা সমাজে বিস্তৃত হতে থাকে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও সুবিধা আসে। স্বাস্থ্যব্যয় কমে এবং কর্মক্ষম দিন বেড়ে যায়। আগে চালকদের পরিবারের প্রায় ৩৫ শতাংশ সদস্য শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভুগতেন, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার পর সেই হার কমতে শুরু করে। ফলে এ নীতি শুধু পরিবেশ নয়, জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণকেও সুরক্ষা দিয়েছে।
সবমিলিয়ে পরিবেশবিদেরা মনে করেন, দুই-স্ট্রোক বেবি-ট্যাক্সি নিষিদ্ধ করা খালেদা জিয়ার পরিবেশ–নীতির অন্যতম সফল ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। লক্ষ্যভিত্তিক নীতিমালা কীভাবে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনকে একসঙ্গে উপকারে আনতে পারে—এ সিদ্ধান্ত তার স্পষ্ট উদাহরণ। এটি আজও খালেদা জিয়ার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের প্রমাণ বহন করে।