স্ট্রিম ডেস্ক

গত ৬ ডিসেম্বর কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত ‘দোহা ফোরাম’ মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রক্রিয়ার দুর্বলতাকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জাসিম আল থানি ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, গাজা যুদ্ধবিরতি এখন একটি ‘ক্রিটিক্যাল মোমেন্ট’ বা সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। যদি দ্রুত স্থায়ী শান্তিচুক্তির দিকে এগোনো না যায়, তবে এই সাময়িক বিরতি যেকোনো সময় পুরোপুরি ভেস্তে যেতে পারে।
চলতি বছরের ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও গাজায় এর সুফল খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা ও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা শান্তি আলোচনাকে গভীর খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো মধ্যস্থতাকারী দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন এই যুদ্ধবিরতি এত জটিল অবস্থায়? কারা এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে? এবং কেন সমালোচকেরা একে ‘কেবল নামেমাত্র বিরতি’ বলে অভিহিত করছেন?
যুদ্ধবিরতির সংজ্ঞা নিয়ে দোহা ফোরামে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জাসিম আল থানি বলেছেন, গাজায় বর্তমানে যা চলছে, তাকে কোনোভাবেই প্রকৃত যুদ্ধবিরতি বা ‘সিজফায়ার’ বলা যায় না; বরং এটি সংঘাতের সাময়িক ‘পজ’ বা বিরতি মাত্র।
সত্যিকারের যুদ্ধবিরতির প্রধান শর্ত হলো দখলদার বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাহার ও স্থানীয় জনগণের স্বাভাবিক চলাচলের স্বাধীনতা। কিন্তু গাজা ভূখণ্ডে এর কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি।
গাজা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে গত সাত সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী অন্তত ৬০০ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। এই সময়ে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৭০ শিশুসহ অন্তত ৩৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইউনিসেফ-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধবিরতি মানে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ করা নয়।’
এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে যে, কাগজে-কলমে চুক্তি থাকলেও, বাস্তবে গাজাবাসী এখনো মৃত্যুভয় নিয়েই দিন কাটাচ্ছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের এই গণহত্যায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৭০ হাজার ১২৫ ছাড়িয়ে গেছে।
লন্ডনভিত্তিক থিংক-ট্যাংক ‘চ্যাথাম হাউস’-এর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক ড. সানাম ভাকিল সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে বলেছেন, ‘গাজায় যা চলছে তা যুদ্ধবিরতি নয়, বরং এটি ইসরায়েলের জন্য পুনরায় সংগঠিত হওয়ার এবং হামাসকে নিঃশেষ করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনারই অংশ। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কেবল সাময়িক বিরতি দিয়ে শান্তি ফেরানো অসম্ভব।’
যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্রক্রিয়া কয়েক ধাপে সম্পন্ন হওয়ার কথা। প্রথম ধাপে হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল, যা সংগঠনটি অনেকাংশেই পালন করেছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান নিশ্চিত করেছেন যে, হামাস তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। জীবিত জিম্মিদের পাশাপাশি মৃত জিম্মিদের দেহাবশেষও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে গাজায় মাত্র একজন জিম্মির মৃতদেহ অবশিষ্ট রয়েছে বলে জানা গেছে।
কিন্তু সমস্যা বেধেছে দ্বিতীয় ধাপে উত্তরণ নিয়ে। এই ধাপে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (আইএসএফ) গঠন, ফিলিস্তিনে একটি টেকনোক্র্যাটিক ও নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের পূর্ণ প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল এই ধাপগুলো বাস্তবায়নে টালবাহানা করছে। হাকান ফিদান স্পষ্ট করেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি এখনই সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ না করে, তবে পুরো প্রক্রিয়া গতি হারাবে ও ভেস্তে যাবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)-এর ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক তাহানি মোস্তফা মনে করেন, ‘দ্বিতীয় ধাপই হলো আসল পরীক্ষা। ইসরায়েল জিম্মিদের ফেরত পাওয়ার পর যুদ্ধে ফিরে যাওয়ার অজুহাত খুঁজছে। হামাস তাদের প্রধান ‘বারগেইনিং চিপ’ বা জিম্মিদের হাতছাড়া করার পর এখন তাদের হাতে ইসরায়েলকে চাপে রাখার মতো খুব কম তাসই অবশিষ্ট আছে।’
শান্তি প্রক্রিয়ার অন্যতম জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে গাজায় একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বা স্থিতিশীলতা বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এই প্রস্তাব অনুমোদন করলেও, এর গঠন ও অংশগ্রহণকারী দেশ নিয়ে মতবিরোধ চরমে। তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এই বাহিনীতে সেনা পাঠাতে আগ্রহী। কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি এর বিরোধিতা করছেন।
হাকান ফিদান দোহা ফোরামে বলেছেন, ‘মি. নেতানিয়াহু কোনো রাখঢাক করছেন না। প্রকাশ্যে তিনি বলছেন যে গাজায় তুর্কি সেনাদের উপস্থিতি দেখতে চান না।’
ইসরায়েলের এই অনড় অবস্থান শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। নিরপেক্ষ বা মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী ছাড়া গাজায় আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও ত্রাণ বিতরণ নিশ্চিত করা অসম্ভব।
মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাত্তি প্রস্তাব দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন তদারকি করতে গাজার তথাকথিত ‘ইয়েলো লাইন’ বরাবর অবিলম্বে আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন করা হোক। তিনি অভিযোগ করেন, ইসরায়েল প্রতিদিন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে এবং উল্টো ফিলিস্তিনিদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।
নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসপেন বার্থ এইড আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, এই মাসের মধ্যেই আন্তর্জাতিক পিস কাউন্সিল গঠন করতে হবে।
যুদ্ধবিরতির জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে রাফাহ ক্রসিং নিয়ে ইসরায়েলের নতুন পরিকল্পনা। ইসরায়েল চাইছে রাফাহ সীমান্ত কেবল ফিলিস্তিনিদের গাজা ত্যাগের জন্য খুলে দেওয়া হোক, কিন্তু ফিরে আসার জন্য নয়। মিসর ও কাতারসহ আট মুসলিম দেশ যৌথ বিবৃতিতে এই পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা আশঙ্কা করছে, এটি আসলে গাজাকে জনশূন্য করার ও ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত করার নীলনকশা।
এই পরিকল্পনাকে বিশ্লেষকরা ‘দ্বিতীয় নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা হিসেবে দেখছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ও কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো মারওয়ান মুয়াশের মতে, ‘ইসরায়েলের এই “এক্সিট-অনলি” বা কেবল প্রস্থানের নীতি প্রমাণ করে যে, তাদের মূল লক্ষ্য হামাস নির্মূল নয়, বরং গাজার ডেমোগ্রাফি বা জনতাত্ত্বিক কাঠামো বদলে দেওয়া। এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই পরিকল্পনা মেনে নিলে মিসর ও জর্ডানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর স্থিতিশীলতা হুমকিতে পড়বে।’
ত্রাণ সহায়তার প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করাও এই পরিকল্পনার অংশ। মানবিক সহায়তা আটকে রেখে জনগণকে গাজা ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে, যা যুদ্ধবিরতির মূল চেতনার পরিপন্থী।
গাজার এই জটিল পরিস্থিতির জন্য অনেক বিশ্লেষক যুক্তরাষ্ট্রের দোদুল্যমান নীতিকে দায়ী করছেন। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যুদ্ধবিরতির কথা বলছে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন ও অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে—এই দ্বিমুখী নীতি মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর কাজ কঠিন করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমানে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো খালেদ এলজিন্দি সম্প্রতি ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। ওয়াশিংটন যদি নেতানিয়াহু সরকারকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় বাধ্য করতে না পারে, তবে দোহা বা কায়রোর কোনো আলোচনাই সফল হবে না। বাইডেন প্রশাসন হোক বা ট্রাম্প প্রশাসন, কেউ-ই ইসরায়েলের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগে ইচ্ছুক নয়।’
দোহা ফোরামে সৌদি আরবের প্রতিনিধি মানাল রাদওয়ান বলেছেন, গাজাকে বিচ্ছিন্ন সংকট হিসেবে দেখলে ভুল হবে। গাজা ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের বৃহত্তর সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংঘাতের মূল কারণ সমাধান না করলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেবল সহিংসতার চক্রাবর্তেই ঘুরপাক খাবে।
মূল কারণ হলো—দখলদারিত্বের অবসান ও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। কিন্তু যুদ্ধবিরতির আলোচনায় এই রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে।
ইসরায়েল গাজাকে নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে দেখছে, আর ফিলিস্তিনিরা একে দেখছে অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির মেরুকরণ যতদিন না কমবে, ততদিন যেকোনো যুদ্ধবিরতিই হবে ক্ষণস্থায়ী।
সার্বিক বিবেচনায়, গাজার যুদ্ধবিরতি এখন সরু সুতার ওপর ঝুলছে। একদিকে ইসরায়েলের অনড় অবস্থান, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব—এই দুইয়ের মাঝে পিষ্ট হচ্ছে গাজার সাধারণ মানুষ। কাতার ও তুরস্কের সতর্কতা অমূলক নয়; যদি এখনই দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করা না যায় এবং আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন না হয়, তবে গাজা আবারও সর্বাত্মক যুদ্ধের দাবানলে পুড়বে।
ইসরায়েল হয়তো হামাসকে সামরিকভাবে দুর্বল করতে পেরেছে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের স্পৃহা বা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে তারা ধ্বংস করতে পারেনি। যুদ্ধবিরতির এই ‘ক্রিটিক্যাল মোমেন্টই’ হয়তো নির্ধারণ করবে আগামীর মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, মিডিল ইস্ট মনিটর, মিডিল ইস্ট আই, আরব নিউজ এবং দ্য গার্ডিয়ান

গত ৬ ডিসেম্বর কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত ‘দোহা ফোরাম’ মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রক্রিয়ার দুর্বলতাকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জাসিম আল থানি ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, গাজা যুদ্ধবিরতি এখন একটি ‘ক্রিটিক্যাল মোমেন্ট’ বা সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। যদি দ্রুত স্থায়ী শান্তিচুক্তির দিকে এগোনো না যায়, তবে এই সাময়িক বিরতি যেকোনো সময় পুরোপুরি ভেস্তে যেতে পারে।
চলতি বছরের ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও গাজায় এর সুফল খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা ও যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা শান্তি আলোচনাকে গভীর খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো মধ্যস্থতাকারী দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন এই যুদ্ধবিরতি এত জটিল অবস্থায়? কারা এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে? এবং কেন সমালোচকেরা একে ‘কেবল নামেমাত্র বিরতি’ বলে অভিহিত করছেন?
যুদ্ধবিরতির সংজ্ঞা নিয়ে দোহা ফোরামে কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জাসিম আল থানি বলেছেন, গাজায় বর্তমানে যা চলছে, তাকে কোনোভাবেই প্রকৃত যুদ্ধবিরতি বা ‘সিজফায়ার’ বলা যায় না; বরং এটি সংঘাতের সাময়িক ‘পজ’ বা বিরতি মাত্র।
সত্যিকারের যুদ্ধবিরতির প্রধান শর্ত হলো দখলদার বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাহার ও স্থানীয় জনগণের স্বাভাবিক চলাচলের স্বাধীনতা। কিন্তু গাজা ভূখণ্ডে এর কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি।
গাজা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে গত সাত সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী অন্তত ৬০০ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। এই সময়ে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৭০ শিশুসহ অন্তত ৩৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইউনিসেফ-এর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধবিরতি মানে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ করা নয়।’
এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে যে, কাগজে-কলমে চুক্তি থাকলেও, বাস্তবে গাজাবাসী এখনো মৃত্যুভয় নিয়েই দিন কাটাচ্ছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের এই গণহত্যায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৭০ হাজার ১২৫ ছাড়িয়ে গেছে।
লন্ডনভিত্তিক থিংক-ট্যাংক ‘চ্যাথাম হাউস’-এর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক ড. সানাম ভাকিল সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে বলেছেন, ‘গাজায় যা চলছে তা যুদ্ধবিরতি নয়, বরং এটি ইসরায়েলের জন্য পুনরায় সংগঠিত হওয়ার এবং হামাসকে নিঃশেষ করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনারই অংশ। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কেবল সাময়িক বিরতি দিয়ে শান্তি ফেরানো অসম্ভব।’
যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, প্রক্রিয়া কয়েক ধাপে সম্পন্ন হওয়ার কথা। প্রথম ধাপে হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল, যা সংগঠনটি অনেকাংশেই পালন করেছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান নিশ্চিত করেছেন যে, হামাস তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। জীবিত জিম্মিদের পাশাপাশি মৃত জিম্মিদের দেহাবশেষও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে গাজায় মাত্র একজন জিম্মির মৃতদেহ অবশিষ্ট রয়েছে বলে জানা গেছে।
কিন্তু সমস্যা বেধেছে দ্বিতীয় ধাপে উত্তরণ নিয়ে। এই ধাপে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (আইএসএফ) গঠন, ফিলিস্তিনে একটি টেকনোক্র্যাটিক ও নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের পূর্ণ প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল এই ধাপগুলো বাস্তবায়নে টালবাহানা করছে। হাকান ফিদান স্পষ্ট করেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি এখনই সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ না করে, তবে পুরো প্রক্রিয়া গতি হারাবে ও ভেস্তে যাবে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)-এর ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিষয়ক জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক তাহানি মোস্তফা মনে করেন, ‘দ্বিতীয় ধাপই হলো আসল পরীক্ষা। ইসরায়েল জিম্মিদের ফেরত পাওয়ার পর যুদ্ধে ফিরে যাওয়ার অজুহাত খুঁজছে। হামাস তাদের প্রধান ‘বারগেইনিং চিপ’ বা জিম্মিদের হাতছাড়া করার পর এখন তাদের হাতে ইসরায়েলকে চাপে রাখার মতো খুব কম তাসই অবশিষ্ট আছে।’
শান্তি প্রক্রিয়ার অন্যতম জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে গাজায় একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বা স্থিতিশীলতা বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এই প্রস্তাব অনুমোদন করলেও, এর গঠন ও অংশগ্রহণকারী দেশ নিয়ে মতবিরোধ চরমে। তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এই বাহিনীতে সেনা পাঠাতে আগ্রহী। কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি এর বিরোধিতা করছেন।
হাকান ফিদান দোহা ফোরামে বলেছেন, ‘মি. নেতানিয়াহু কোনো রাখঢাক করছেন না। প্রকাশ্যে তিনি বলছেন যে গাজায় তুর্কি সেনাদের উপস্থিতি দেখতে চান না।’
ইসরায়েলের এই অনড় অবস্থান শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে। নিরপেক্ষ বা মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী ছাড়া গাজায় আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও ত্রাণ বিতরণ নিশ্চিত করা অসম্ভব।
মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাত্তি প্রস্তাব দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন তদারকি করতে গাজার তথাকথিত ‘ইয়েলো লাইন’ বরাবর অবিলম্বে আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন করা হোক। তিনি অভিযোগ করেন, ইসরায়েল প্রতিদিন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করছে এবং উল্টো ফিলিস্তিনিদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।
নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসপেন বার্থ এইড আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, এই মাসের মধ্যেই আন্তর্জাতিক পিস কাউন্সিল গঠন করতে হবে।
যুদ্ধবিরতির জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে রাফাহ ক্রসিং নিয়ে ইসরায়েলের নতুন পরিকল্পনা। ইসরায়েল চাইছে রাফাহ সীমান্ত কেবল ফিলিস্তিনিদের গাজা ত্যাগের জন্য খুলে দেওয়া হোক, কিন্তু ফিরে আসার জন্য নয়। মিসর ও কাতারসহ আট মুসলিম দেশ যৌথ বিবৃতিতে এই পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা আশঙ্কা করছে, এটি আসলে গাজাকে জনশূন্য করার ও ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত করার নীলনকশা।
এই পরিকল্পনাকে বিশ্লেষকরা ‘দ্বিতীয় নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়ের শঙ্কা হিসেবে দেখছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক ও কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো মারওয়ান মুয়াশের মতে, ‘ইসরায়েলের এই “এক্সিট-অনলি” বা কেবল প্রস্থানের নীতি প্রমাণ করে যে, তাদের মূল লক্ষ্য হামাস নির্মূল নয়, বরং গাজার ডেমোগ্রাফি বা জনতাত্ত্বিক কাঠামো বদলে দেওয়া। এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই পরিকল্পনা মেনে নিলে মিসর ও জর্ডানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর স্থিতিশীলতা হুমকিতে পড়বে।’
ত্রাণ সহায়তার প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করাও এই পরিকল্পনার অংশ। মানবিক সহায়তা আটকে রেখে জনগণকে গাজা ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে, যা যুদ্ধবিরতির মূল চেতনার পরিপন্থী।
গাজার এই জটিল পরিস্থিতির জন্য অনেক বিশ্লেষক যুক্তরাষ্ট্রের দোদুল্যমান নীতিকে দায়ী করছেন। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যুদ্ধবিরতির কথা বলছে, অন্যদিকে ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন ও অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে—এই দ্বিমুখী নীতি মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর কাজ কঠিন করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমানে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো খালেদ এলজিন্দি সম্প্রতি ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। ওয়াশিংটন যদি নেতানিয়াহু সরকারকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় বাধ্য করতে না পারে, তবে দোহা বা কায়রোর কোনো আলোচনাই সফল হবে না। বাইডেন প্রশাসন হোক বা ট্রাম্প প্রশাসন, কেউ-ই ইসরায়েলের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগে ইচ্ছুক নয়।’
দোহা ফোরামে সৌদি আরবের প্রতিনিধি মানাল রাদওয়ান বলেছেন, গাজাকে বিচ্ছিন্ন সংকট হিসেবে দেখলে ভুল হবে। গাজা ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের বৃহত্তর সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংঘাতের মূল কারণ সমাধান না করলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেবল সহিংসতার চক্রাবর্তেই ঘুরপাক খাবে।
মূল কারণ হলো—দখলদারিত্বের অবসান ও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি। কিন্তু যুদ্ধবিরতির আলোচনায় এই রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে।
ইসরায়েল গাজাকে নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে দেখছে, আর ফিলিস্তিনিরা একে দেখছে অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির মেরুকরণ যতদিন না কমবে, ততদিন যেকোনো যুদ্ধবিরতিই হবে ক্ষণস্থায়ী।
সার্বিক বিবেচনায়, গাজার যুদ্ধবিরতি এখন সরু সুতার ওপর ঝুলছে। একদিকে ইসরায়েলের অনড় অবস্থান, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব—এই দুইয়ের মাঝে পিষ্ট হচ্ছে গাজার সাধারণ মানুষ। কাতার ও তুরস্কের সতর্কতা অমূলক নয়; যদি এখনই দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করা না যায় এবং আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন না হয়, তবে গাজা আবারও সর্বাত্মক যুদ্ধের দাবানলে পুড়বে।
ইসরায়েল হয়তো হামাসকে সামরিকভাবে দুর্বল করতে পেরেছে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের স্পৃহা বা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে তারা ধ্বংস করতে পারেনি। যুদ্ধবিরতির এই ‘ক্রিটিক্যাল মোমেন্টই’ হয়তো নির্ধারণ করবে আগামীর মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, মিডিল ইস্ট মনিটর, মিডিল ইস্ট আই, আরব নিউজ এবং দ্য গার্ডিয়ান

ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু বিনোদন নয়—মত প্রকাশ, পরিচয় নির্মাণ ও বিশ্বসংযোগেরও প্রধান মাধ্যম। এমন এক সময়ে অস্ট্রেলিয়া ১৬ বছরের নিচের ব্যবহারকারীদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার ঐতিহাসিক আইন পাস করেছে।
৭ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে। এটি বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অধ্যাদেশের ফলে সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় গঠিত হয়। এতে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা সরাসরি প্রধান বিচারপতির অধীনে আসে।
১ দিন আগে
ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছেন কিনা, কোনো কারচুপি হচ্ছে কিনা কিংবা নির্বাচনী কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা—এসব বিষয় তদারকি করে প্রতিবেদন দেওয়াই তাদের কাজ।
২ দিন আগে
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না হলেও, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোববার (৭ ডিসেম্বর) কমিশনের বৈঠক থেকে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
২ দিন আগে