leadT1ad

একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর কাদের হারিয়েছে বাংলাদেশ

১৪ ডিসেম্বর বাঙালির জীবনে এক গভীর শোকের দিন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ঠিক প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সেই রাতে তারা জাতির সূর্যসন্তানদের বাড়ির দরজায় গিয় ঠকঠক করে বলে, ‘স্যার, বাসায় আছেন? একটু কথা ছিল।’ এভাবেই তারা বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান—শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পী ও সাহিত্যিকদের।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

১৯৭১ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের কয়েকজন। ছবি: সংগৃহীত

‘ঠক ঠক, ঠক ঠক! স্যার একটু বাইরে আসবেন?’—এই কথাটি কানে এলেই আমাদের মনে পড়ে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরের কথা। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায়। এই দিনেই আলবদর বাহিনী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে হত্যা করেছিল। কারণ, তারা চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে।

পরিকল্পিতভাবে সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, লেখক, দার্শনিক, গবেষক, নাট্যকার ও অভিনয়শিল্পীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরে নিয়ে যায় তারা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে বলা হয়েছিল, কিছুক্ষণ পরে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এরপর আর কাউকেই ছেড়ে দেওয়া হয়নি। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের।

নিশ্চয়ই সেলিনা পারভীনের কথা মনে আছে? সে সময় তিনটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। ১৩ ডিসেম্বর সিদ্ধেশ্বরীর ১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডের বাসার ছাদে রোদ পোহাচ্ছিলেন সেলিনা পারভীন আর তাঁর ছেলে সুমন। ছোট্ট সুমন খেলছিল, ছুটোছুটি করছিল; আর তাঁর মা চেয়ারে বসে কিছু একটা লিখছিলেন।

শহরে তখন কারফিউ, রাস্তায় মিলিটারি। হঠাৎ তাঁদের উল্টো দিকের বাসার সামনে এসে থামল একটি মাইক্রোবাস আর একটি লরি। গেট ভেঙে ঢুকে গেল আলবদর বাহিনী। একটু পর তাঁদের বাড়ির দরজাতেও ঠক ঠক করে কড়া নাড়ার শব্দ হলো। দরজা খুলে দিলেন সেলিনা পারভীন। আলবদর বাহিনী নাম জিজ্ঞেস করল। উত্তরে বললেন, ‘সেলিনা পারভীন’। পরিচয় নিশ্চিত হয়ে আলবদর বাহিনী নিয়ে গেল তাঁকে।

১৮ ডিসেম্বর সেলিনা পারভীনের মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। গুলিতে-বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত শরীর। পায়ে তখনো রক্তমাখা সাদা মোজা জোড়া। পরিকল্পিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী তাঁকেও নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল।

‘প্রিয়তমাসু, পান্না কায়সার, আমার ছেলেমেয়েগুলোকে তুমি যত্নে রেখো। আমি জানি, তুমি পারবে। তুমি ভালো থেকো। আমি কখনো কোথাও তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাব না।’—১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, এ রকমই একটি চিঠি প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে লিখেছিলেন শহীদুল্লাহ কায়সার। ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁর স্ত্রী যখন তাঁদের কন্যাসন্তানকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন, ঠিক সে সময় তাঁদের দরজায় ঠক ঠক শব্দ হয়। দরজা খুলে দেন তাঁর বোন। মুখে কাপড় প্যাঁচানো কয়েকজন এসে নিয়ে যায় লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো দিন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি জিনিসের সঙ্গেই সখ্য তৈরি হয়েছিল। রাইফেল দিয়ে মানুষ মারত, ক্ষুধা লাগলে খেত আর যখন-তখন করত বাঙালি নারীদের সঙ্গে অনাচার। শিক্ষাবিদ আনোয়ার পাশা এসব নিজের চোখে দেখেছিলেন। সে সময়ই লিখেছিলেন ‘রাইফেল রোটি অওরাত’ নামের বই। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বাসা থেকে আলবদর বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। ২২ দিন পর তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায় মিরপুর এলাকার বধ্যভূমিতে। অথচ ১২ ডিসেম্বর তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘এবার কারফিউ উঠলেই বাজার করে আনব।’

১৪ ডিসেম্বর সকালবেলা শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী তাঁর স্ত্রীকে বলছিলেন, দেশ এবার স্বাধীন হয়ে যাবে। দুপুরবেলা গোসল সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন (বা চুলে চিরুনি দিচ্ছিলেন)। তাঁর মা রান্না করেছেন, খেতে বসবেন একটু পরেই। সে সময়ই আলবদর বাহিনী একটু পরে ফিরে আসবে বলে তাঁকে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় মা বললেন, ‘খেয়ে যা’। মুনীর চৌধুরী বললেন, ফিরে এসে খাবেন। আর কোনো দিন ফিরে আসেননি তিনি। এমনকি তাঁর লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্যতম একজন সাক্ষীর মুখ থেকে জানা যায়, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে মুনীর চৌধুরীকে পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়। ধারণা করা হয়, তাঁর লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

শুধু ১৪ ডিসেম্বরই নয়, এর আগেও মেরে ফেলা হয়েছে আরও অনেককে। এর মধ্যে চিকিৎসক ফজলে রাব্বীর কথাই ভাবুন। ১৫ ডিসেম্বর বাড়িতে বাজার করে আনলেন কত কিছু। স্ত্রী ডা. জাহানারা রাব্বীকে বললেন, ‘দ্যাখ, কত বাজার করে এনেছি! সারেন্ডারের সময় এখন, খুব গোলমাল হবে। কোনো জিনিস পাওয়া যাবে না। তুমি ভয় পেয়ো না।’ তাঁরা ভাবছিলেন অন্য কারও বাড়িতে থাকবেন। ব্যাগ গোছানো। বিকেলে অ্যাম্বুলেন্সে করে চলে যাবেন। দুপুরে খুব আয়েশ করে খেয়ে ফজলে রাব্বী তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘টিংকুর আম্মা, আজকের দিনে এত ভালো করে খাবার খেলাম, কী ভালো খাওয়ালে তুমি!’

বিকেল চারটায় বাড়ি ঘিরে ফেলল আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনা। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘টিংকুর আম্মা, আমাকে ওরা নিতে এসেছে।’ তুলে নিয়ে গেল ফজলে রাব্বীকে। তাঁর স্ত্রী অনেক চেষ্টা করেছিলেন আটকাতে; কিন্তু পারেননি। সেদিনই জাহানারা রাব্বী কর্নেল হেজাজীর কাছে জানতে পেরেছিলেন, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরীসহ আরও ২০ জন অধ্যাপককেও তুলে নিয়ে গেছে। তাঁকেও পৈশাচিক নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছিল মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে।

সেখান থেকে বেঁচে ফেরা একটি ছেলে জাহানারা রাব্বীকে বলেছিলেন, ‘মরে যাওয়ার সময় তিনি “টিংকুর আম্মা” বলেই মারা গিয়েছিলেন।’

১৪ ডিসেম্বরের আগেও অর্থাৎ পুরো নয় মাস ধরেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও আলবদর বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ধরে ধরে হত্যা করেছিল।

১৯৭১ সালে ঢাকায় অপারেশনে আসা গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখার একটি নিরাপদ স্থান ছিল আলতাফ মাহমুদের বাড়ি। তাঁর বাড়ির মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হতো অস্ত্র। কিন্তু ৩০ আগস্ট ভোরবেলা তাঁর বাড়ির দরজায় ঠক ঠক শব্দ হলো। ভেতরে ঢুকল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল। মাটি খুঁড়ে বের করা হলো অস্ত্র। তাঁকে নিয়ে গেল নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেলের টর্চার সেলে। সঙ্গে নিয়ে গেল তাঁর চার শ্যালককে। তাঁর শ্যালকদের বলে দিয়েছিলেন অস্ত্রের কথা অস্বীকার করতে। এরপর তাঁরা ছাড়া পেলেও আলতাফ মাহমুদকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এবং জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ। তিনি ২৫ মার্চ রাতে স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে বলেন, ‘সবাই আমাকে সাত দিন দূরে থাকতে বলছে। কিন্তু আমি হলের প্রভোস্ট, আমি কী করে আমার ছাত্রদের ফেলে যাব? আমি জানি, কিছু হলে আমাকেই আগে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।’ তিনি থেকে গিয়েছিলেন তাঁর ফ্ল্যাটে। ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন অধ্যাপককে গুলি করা হয়। সবাই সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করলেও জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ৩০ মার্চ পর্যন্ত হাসপাতালে লড়েছেন নিজের জীবনের সঙ্গে। ডাক্তারেরা তাঁর শরীর থেকে গুলি পর্যন্ত বের করতে পারেননি।

৭১-এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্টোবর ভবনের নাম ছিল অনুদ্বৈপায়ন ভবন। কারণ, ২৬ মার্চ সকালবেলা এখানেই হত্যা করা হয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে। তখন জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর ছিলেন তিনি। ঘটনাটি চুপিচুপি দেখেছিলেন পাশের ভবনের দারোয়ান মাখন।

প্যারীমোহন আদিত্য ছিলেন একজন নাট্যকার, অভিনয়শিল্পী ও সাংবাদিক। সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন, সহায়তা করতেন নানাভাবে। স্থানীয় রাজাকারদের কাছে পৌঁছে যায় খবরটি। ৮ আগস্ট টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে সৎসঙ্গ আশ্রমে অভিযান চালিয়ে গুলি করা হয় তাঁকে। মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে তাঁর সারা শরীরে বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হলেও মুখ থেকে একটি কথা বের করেননি তিনি। একটা সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিন দিন পরে তাঁর লাশ খুঁজে পায় তাঁর পরিবার।

দীর্ঘ নয় মাস ধরে চালানো এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের তালিকায় আর কত শত জনের নাম যে রয়েছে, তা হিসাব করে শেষ করার মতো নয়। শিক্ষক অজিত কুমার চক্রবর্তী, অভিনয়শিল্পী অনিল চন্দ্র মল্লিক, চিকিৎসক আব্দুল জব্বার, সংগীতশিল্পী উত্তম কুমার পাল, প্রকৌশলী এ কে এম শামসুদ্দীন, আইনজীবী জ্ঞানেন্দ্রলাল চৌধুরী, আইনজীবী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সংস্কৃতিকর্মী মৃণালকান্তি দাস, প্রকৌশলী ফজলুর রহমান, হোমিও চিকিৎসক বগলা প্রসাদ ভট্টাচার্য প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যেকের অবদান অতুলনীয়।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের এসব নির্মম সত্য বর্ণনা এখনো পড়তে গেলে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আমরা আজ তাঁদের কথা জানতে পারছি বিভিন্ন বই, পত্রিকা ও নাটক থেকে। কিন্তু এসব নির্মম সত্য ঘটনা দীর্ঘ নয় মাস ধরে ঘটেছে এ দেশের মাটিতে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত