মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে যখন পুরো জাতি স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর, ঠিক তখনই বাংলাদেশের বুকে নেমে আসে এক ভয়াল অন্ধকার। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা মিলে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছিল এদেশের সূর্যসন্তানদের। যদিও সেই নিধনযজ্ঞ শুরু হয়েছিল মার্চে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই। তবে তা তীব্র আকার ধারণ করেছিল ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে, এই হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
এর প্রমাণ মিলেছে খোদ পাকিস্তানি জেনারেলদের ডায়েরি এবং বিভিন্ন সময় তাদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে। ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই ভয়াবহ ইতিহাসের দলিলাদি, রাও ফরমান আলীর ডায়েরির বক্তব্য এবং পাকিস্তানি জেনারেলদের নিজেদের লেখা বইয়ে দেওয়া স্বীকারোক্তির তথ্য।
বুদ্ধিজীবী কারা: ইতিহাসের নির্ধারিত সংজ্ঞা
১৪ ডিসেম্বরের প্রেক্ষাপটে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’ কাদের বলা হবে, তা নিয়ে ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ সরকার একটি ব্যাখা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যারা তাদের মেধা, মনন, সাহিত্য ও কর্ম দিয়ে দেশের সংস্কৃতি ও জাতীয়তা গঠনে ভূমিকা রেখেছেন, তারাই বুদ্ধিজীবী।
এই আওতায় রয়েছেন দেশের শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কবি ও লেখকরা। একই সঙ্গে ডাক্তার, প্রকৌশলী, স্থপতি, আইনজীবী, শিল্পী, গায়ক, ভাস্কর এবং সংস্কৃতিসেবীরাও এই কাতারে পড়েন। এমনকি সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী যারা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের নেপথ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, তারাও এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।
রাও ফরমান আলীর ডায়েরি ও ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে সেই কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের মুহূর্ত। জন্ম হয় একটি নতুন স্বাধীন দেশের। স্বাধীনতার পর তৎকালীন গভর্নর হাউস বা বর্তমান বঙ্গভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করা হয়। এটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডায়েরি, যা ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন বলছে, সেই ডায়েরির পাতায় নিজ হাতে লেখা ছিল অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নাম। অর্থাৎ কাকে হত্যা করা হবে বা কাদের টার্গেট করা হয়েছে, তারই এক খসড়া ছিল এই ডায়েরি।
রাও ফরমান আলীর বই ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ এবং নিয়াজীর লেখা বই ‘দ্য বিট্রেয়াল অফ ইস্ট পাকিস্তান’। স্ট্রিম গ্রাফিকপরবর্তীতে রাও ফরমান আলী ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ নামে একটি বই লেখেন। সেই বইয়ে এবং পাকিস্তানের খ্যাতিমান সাংবাদিক আলতাফ গওহরের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এই তালিকার কথা স্বীকার করলেও চতুরতার সঙ্গে হত্যার দায় অস্বীকার করে বলেন, ‘তিনি নাকি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করেছিলেন তাদের দিয়ে ‘‘পক্ষাবলম্বন’’ করানোর জন্য বা মিটিংয়ে ডাকার জন্য, হত্যার জন্য নয়।’
কিন্তু ১৪ ডিসেম্বরের বাস্তবতা প্রমাণ করে, সেই তালিকাটি ছিল আসলে একটি ‘ডেথ ওয়ারেন্ট’।
জেনারেল নিয়াজীর ‘দ্য বিট্রেয়াল অফ ইস্ট পাকিস্তান’ ও পাল্টাপাল্টি দোষারোপ
বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনায় যে পাকিস্তানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত ছিলেন, এ বিষয়টি তাদের নিজেদের লেখা বই এবং বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজীর লেখা বই ‘দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে একাত্তরের বিভিন্ন দিক পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে।
এই বইয়ে জেনারেল নিয়াজী বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় সরাসরি রাও ফরমান আলীর কাঁধে চাপান।
নিয়াজী লিখেছেন, রাও ফরমান আলী তার কাছে এসে অনুরোধ করেছিলেন যে, বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করার জন্য তার গাড়ি এবং লোকবল দরকার। নিয়াজী স্বীকার করেছেন, তিনি ফরমান আলীকে সেই সহায়তা দিয়েছিলেন।
নিয়াজীর এই বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ধরে ধরে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি শীর্ষ মহলে জানাজানি ছিল এবং তাদের সম্মতিতেই তা হয়েছে। এটি কোনো বিচ্ছিন হত্যাকাণ্ড নয়।
ঘাতক আল-বদর ও তাদের দোসর
এই পৈশাচিক পরিকল্পনাটি রাও ফরমান আলী বা নিয়াজীরা তৈরি করলেও, মাঠ পর্যায়ে অচেনা অলিগলি চিনে তা বাস্তবায়ন করেছিল তাদের এদেশীয় দোসর ‘আল-বদর’ বাহিনী। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’-এর সদস্যদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনী ছিল অত্যন্ত সংঘবদ্ধ।
রাও ফরমান আলীর সেই তালিকা ধরে আল-বদররাই বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে তুলে এনেছিল। আর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অস্ত্র ও সুরক্ষা দিয়ে এই দোসরদের আরও শক্তিশালী করেছে।
রাও ফরমান আলীর ডায়েরি আর জেনারেল নিয়াজীর বইয়ের স্বীকারোক্তি, সবকিছুই বুদ্ধিজীবি হত্যার নীলনকশার দিকে ইঙ্গিত দেয়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের মেধাবী সন্তানদের হত্যার মাধ্যমে একটি জাতিকে মেধাশূণ্য করার যে অপচেষ্টা, তা সফল হয়েছে এদেশের মাটিতে জন্ম নেওয়া পাকবাহিনীর দোসর- রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর কারণে।