‘আমরা বর্ষার অপেক্ষায় আছি… তাঁরা পানিকে ভয় পায়, আর আমরা হচ্ছি জলের রাজা। প্রকৃতি হবে আমাদের দ্বিতীয় বাহিনী।’ নিউইয়র্ক টাইমসের খ্যাতিমান সাংবাদিক সিডনি শনবার্গের ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ’ প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছিলেন এক বাঙালি অফিসার।
একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ কেবল সমরাস্ত্রের ছিল না। এই জনযুদ্ধে প্রকৃতির এক বিশাল ভূমিকাও ছিল। বিশেষ করে বর্ষাকাল ছিল একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের এক অঘোষিত মিত্র বা ‘সেকেন্ড আর্মি’।
ভৌগলিক ও আবহাওয়াগত এই সুবিধা কাজে লাগিয়েছিল বাঙালিরা। এটি কাজে লাগিয়ে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতেও সক্ষম হয়েছিল তাঁরা। সমরবিদ ও ইতিহাসবিদদের মতে, একাত্তরের বর্ষা ছিল যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক প্রাকৃতিক রণকৌশল।
এই পর্যবেক্ষণ ছিল অত্যন্ত নিখুঁত। বর্ষার সময় পাকিস্তানি সেনাদের ভারী বুট ও যান চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে খালি পায়ে বা হালকা নৌকায় চলাচলে অভ্যস্ত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা এই সুযোগে গেরিলা তৎপরতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।
সংগৃহীত ছবিবর্ষাকালীন অভিযান
রণকৌশলগত দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, বর্ষাকাল ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লেফটেনেন্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ও সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, বর্ষাকালে পূর্ণমাত্রার সম্মুখযুদ্ধে যাওয়া আত্মঘাতী হবে। কারণ, বর্ষায় প্লাবিত বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভারী সরঞ্জাম পরিবহন অসম্ভব হয়ে পড়বে। চীন সীমান্তে তুষারপাত না থাকায় উত্তরের হুমকিও থাকবে বলবৎ। তাই কৌশল হিসেবে বেছে নেওয়া হয় ‘মনসুন অফেন্সিভ’ বা বর্ষাকালীন অভিযান।
পরিকল্পনা ছিল, বর্ষার মাসগুলোতে (জুন-সেপ্টেম্বর) পাকিস্তানি বাহিনীকে নিয়মিত গেরিলা হামলার মাধ্যমে ব্যতিব্যস্ত রাখা। তাঁদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। লজিস্টিক সাপ্লাই চেইন ধ্বংস করা। জেনারেল (অব.) দীপঙ্কর ব্যানার্জির মতে, ভারতীয় সেনারা মূলত পাহাড়ি যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। তাই নদীমাতৃক বাংলাদেশে যুদ্ধের জন্য তাঁদের বর্ষাকালে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। চূড়ান্ত আঘাতের জন্য শীতকাল (নভেম্বর-ডিসেম্বর) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
অপারেশন জ্যাকপট
এই বর্ষাকালীন যুদ্ধের সবচেয়ে বড় সাফল্য ও নাটকীয় মোড় ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে যখন নদ-নদী কানায় কানায় পূর্ণ এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, তখনই নৌ-কমান্ডোরা ইতিহাসের অন্যতম সেরা অভিযানটি পরিচালনা করেন। ১৫ আগস্টের সেই কালরাত্রিতে প্রবল বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়া ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আশীর্বাদ। দৈনিক ইত্তেফাক ও আবহাওয়া দপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, সে সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছিল।
এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পাকিস্তানি প্রহরীদের নজরদারি ছিল শিথিল। বৃষ্টির শব্দে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল নৌ-কমান্ডোদের চলাচলের শব্দ। চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে পরিচালিত এই হামলায় পাকিস্তানি ২৬টি জাহাজ ও গানবোট ধ্বংস হয়। দাউদকান্দি ফেরিঘাটে ১৬ আগস্টের অপারেশনেও দেখা যায়, কচুরিপানা ও বৃষ্টির আড়াল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে বিস্ফোরক স্থাপন করে নিরাপদে সরে এসেছিলেন। বর্ষার এই উত্তাল স্রোত ও অন্ধকারকে কাজে লাগিয়েই বাঙালি নৌ-কমান্ডোরা বিশ্বের বুকে এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছিলেন।
ছদ্মবেশে যুদ্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা
বর্ষা ও জলজ উদ্ভিদের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল এক অনন্য গেরিলা কৌশল। বর্ষায় খাল-বিল ও নদীনালায় ভেসে আসা কচুরিপানার স্তূপ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রাকৃতিক ছদ্মবেশ ও বাঙ্কারের কাজ করেছে। আধুনিক সমরাস্ত্রের বিপরীতে কচুরিপানা হয়ে উঠেছিল এক অদৃশ্য ঢাল। সমকালীন বিভিন্ন দলিল ও স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি গানবোটের সার্চলাইটের আলোতেও কচুরিপানার নিচে নাক ভাসিয়ে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের শনাক্ত করা সম্ভব হতো না। কেবল যোদ্ধারা নন, অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও সম্ভ্রম রক্ষায় নারীরা বর্ষার প্লাবিত বিলগুলোতে কচুরিপানার নিচে আশ্রয় নিয়ে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করেছেন।
সংগৃহীত ছবিবাঞ্ছারামপুরের মেঘনা নদীতে কলাগাছের ভেলার সঙ্গে কচুরিপানা দিয়ে শরীর ঢেকে লঞ্চ আক্রমণের ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, বর্ষা কীভাবে সাধারণ মানুষকেও দুর্ধর্ষ যোদ্ধায় পরিণত করেছিল। পাকিস্তানি সেনারা এই ‘জলযুদ্ধ’ বা ‘রিভারাইন ওয়ারফেয়ার’-এ এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে, তাঁরা বর্ষাকালে ঢাকার বুড়িগঙ্গায় রাবার বোটে চড়ে এবং কচুরিপানা মাথায় দিয়ে মহড়া দিতে বাধ্য হয়েছিল, যা সরদার ফজলুল করিমের দিনলিপিতে বিদ্রূপাত্মকভাবে উঠে এসেছে।
বর্ষার ক্ষতিকর দিকও ছিল
তবে বর্ষার এই ভূমিকা কেবল একপাক্ষিক ছিল না। এর একটি মানবিক ও মর্মান্তিক দিকও ছিল। যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীর জন্য বর্ষাকাল ছিল অভিশাপস্বরূপ। সীমান্ত সংলগ্ন শরণার্থী শিবিরগুলো বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। ছড়িয়ে পড়েছিল কলেরা ও ডায়রিয়ার মতো মহামারি। ইউএনএইচসিআর-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্ষার কারণে ত্রাণের গাড়ি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। এছাড়া সিডনি শনবার্গ তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন, যুদ্ধের কারণে আমন ধানের রোপণ ব্যাহত হওয়ায় বর্ষা পরবর্তী সময়ে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ, যে বর্ষা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল আশীর্বাদ, সেই একই বর্ষা গৃহহীন ও শরণার্থীদের জন্য নিয়ে এসেছিল অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বর্ষাকালের ভূমিকা ছিল দ্বান্দ্বিক কিন্তু নির্ণায়ক। এটি পাকিস্তানি বাহিনীর আধুনিক যান্ত্রিক সুবিধাকে অকেজো করে দিয়েছিল। বিচ্ছিন্ন করেছিল তাঁদের যোগাযোগ ব্যবস্থা। মানসিকভাবে করে তুলেছিল বিপর্যস্ত।
অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীকে দিয়েছিল প্রাকৃতিক সুরক্ষা, চলাচলের সুবিধা এবং আচমকা আক্রমণের সুযোগ। শরণার্থীদের জন্য এটি ছিল চরম কষ্টের হওয়া সত্ত্বেও বৃহত্তর বিজয়ের প্রেক্ষাপটে বর্ষা ছিল বাঙালির ‘সেকেন্ড আর্মি’।
প্রকৃতির এই রুদ্ররূপ যদি সেদিন সহায় না হতো, তবে হয়তো ডিসেম্বরের বিজয়ের জন্য বাঙালিকে আরও দীর্ঘ সময় ও রক্তমূল্য দিতে হতো। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বর্ষাকাল কেবল একটি ঋতু নয়, বরং এক অকুতোভয় সহযোদ্ধার নাম।