leadT1ad

দীপু দাস হত্যাকাণ্ড: নৃশংসতা যেভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে

রাতুল আল আহমেদ
রাতুল আল আহমেদ

প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ০১
গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে ময়মনসিংহে একজন হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। স্ট্রিম গ্রাফিক

গত এক সপ্তাহজুড়ে দেশে-বিদেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার ভিড়ে গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে ময়মনসিংহে একজন হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাটি দেশে তেমন ক্ষোভের জন্ম দেয়নি। যদিও আন্তর্জাতিক পরিসরে এই মব-সন্ত্রাসের ঘটনা তীব্র আলোড়ন তৈরি করেছে।

ময়মনসিংহের ভালুকায় ‘পাইওনিয়ার নিট ফ্যাক্টরি’তে কর্মরত ২৮ বছর বয়সী পোশাককর্মী দীপু চন্দ্র দাসকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাটিকে কেবল হঠাৎ ক্ষোভ বা ঘৃণার একটি বিচ্ছিন্ন বিস্ফোরণ হিসেবে দেখলে ভুল হবে। পুরো ঘটনাটিকে নেহাত সাদা চোখে দেখার চেষ্টা হবে সেটি। এই ভয়াবহ লিঞ্চিং বা গণপিটুনি আসলে দীর্ঘদিন ধরে চলা সহিংসতাকে স্বাভাবিক দেখানোর যে প্রক্রিয়া চলমান, তারই পরিণতি। এই প্রক্রিয়ায় ঘৃণা ধীরে ধীরে নৈতিক সমর্থন পায়, সমাজ তা মেনে নেয় এবং শেষ অবধি তা দলগত সহিংসতায় গিয়ে ঠেকে।

দীপু চন্দ্র দাস ইসলাম সম্পর্কে অবমাননাকর কিছু বলেছেন—এমন গুজব সহকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে তাঁর কারখানার গেটে একদল মানুষ জড়ো হয়। তারা কর্তৃপক্ষের কাছে দীপুকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি তোলে। এরপর সেই অসহায় মানুষটিকে টেনে নেওয়া হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। সেখানে তাঁকে মারধর করা হয়, একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এবং শেষে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এই বিভীষিকাময় দৃশ্য হামলাকারীরাই ভিডিও করে এবং পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, দীপুকে কারখানা থেকে টেনে বের করে আনার সময় ঘটনাস্থলে পুলিশও উপস্থিত ছিল।

যখন কোনো ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর একজন শ্রমিককে এমন একটি অভিযোগের ভিত্তিতে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়—যে অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই বলে পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেই জানায়—তখন একে কেবল জনতার সহিংসতা বলা যায় না। এটি হলো চরম বিদ্বেষ থেকে জন্ম নেওয়া একটি ঘৃণাজনিত অপরাধ।

বরং এখানে কাজ করছে মানসিক ও সামাজিক মানদণ্ডের একটি গভীর পরিবর্তন, যা এ ধরনের নিষ্ঠুর নিপীড়নকে সম্ভব করে তুলছে। এ ছাড়া দীপুর ওপর হামলার সময় বারবার ‘শাতিম’ (ধর্ম অবমাননাকারী) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘ধর্ম অবমাননা’র মতো ধারণা ধর্মীয় পরিসর ছাড়িয়ে অপছন্দের কোনো ব্যক্তি বা দলকে তকমা দেওয়ার সামাজিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। এখন অনায়াসে ফেসবুক পোস্ট, রোজগেরে চায়ের আড্ডা থেকে ধর্মীয় বয়ানেও এই শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

দীপুর মৃত্যু আমাদের দেখিয়ে দেয়, কীভাবে একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে ঠিক এই অবস্থায় ঠেলে দেওয়া যায়। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এখানে কাউকে ‘উনমানুষ’ বানানোর মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নৈতিক ও আইনি সমাজের বাইরে ছুড়ে ফেলে।

মনোবিজ্ঞানী গর্ডন অলপোর্টের গবেষণা থেকে এ ধরনের অভিযোগ কীভাবে কাজ করে, তার একটা হদিস পেতে পারি আমরা। তাঁর মতে, বিদ্বেষ সাধারণত সহিংসতা দিয়ে শুরু হয় না; বরং এমন কথাবার্তা দিয়ে শুরু হয়, যেগুলো প্রথমে মেনে নেওয়া হয়, বারবার বলার মাধ্যমে সামাজিক স্বীকৃতি পায় এবং শেষে গিয়ে বাস্তবে ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘ধর্ম অবমাননা’ শব্দটির এই লাগাতার ব্যবহার মানুষের নৈতিক সক্ষমতাকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে তুলছে। এ ধরনের ঘৃণামূলক তকমা যখন দৈনন্দিন ভাষার অংশ হয়ে যায়, তখন তা মানুষের চিন্তায় একধরনের ‘শর্টকাট’ তৈরি করে দেয়। ফলে কারও গায়ে এই তকমা সাঁটা হলে তাঁকে আর একজন মানুষ হিসেবে দেখা হয় না; বরং তাঁকে একধরনের অপরাধের প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।

দীপুর ক্ষেত্রে প্রমাণের অনুপস্থিতি অভিযোগটিকে দুর্বল করেনি, কারণ সেটির প্রয়োজনই ছিল না। অভিযোগটি আগেই সমাজে আক্রমণের জন্য যথেষ্ট বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল। ফলে সমাজ যখন এই সিঁড়ির প্রথম ধাপ—নিন্দা ও একঘরে করে দেওয়াকে মেনে নেয়, তখন এরপর যে সহিংসতা ঘটে, তাকে আর সীমালঙ্ঘন বলে মনে হয় না।

দীপুকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার পর ফেসবুকে কয়েকজন ব্যক্তি লাইভে এসে এই হত্যাকাণ্ডকে উদযাপন করেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন জুবায়ের আহমেদ তাশরিফ, যাঁর ফেসবুকে অনুসারীর সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি এবং যিনি একজন সম্ভাব্য স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী। অথবা খতিব হোসাইন আহমেদ আল-হাবিবের মতো মানুষ, যিনি ইউটিউব ও ফেসবুকে নিয়মিত ধর্মীয় বয়ান প্রচার করেন। তাঁরা এই হত্যাকে ‘ধর্ম অবমাননার ন্যায্য বিচার’ বলে দাবি করেন।

এই ঘটনাগুলো দেখায়, কীভাবে সহিংসতাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক, এমনকি সম্মানজনক হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়। লিঞ্চিংকে সঠিক ও সাহসী বিচার হিসেবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে হত্যাকে প্রশংসনীয় এবং ‘দরকার পড়লে আবার করা যাবে’—এমন ঘটনা হিসেবে দাঁড় করানো হয়। এটি ইতিহাসবিদ হানা আরেন্টের ভাষায় ‘ব্যানালিটি অব ইভিল’ বা ‘মন্দের স্বাভাবিকতা’র ধারণাটিকেও সামনে আনে, যেখানে হত্যাকে নিষ্ঠুরতা হিসেবে নয়, বরং কর্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। হামলাকারীদের প্রশংসা করে এবং তাদের ‘প্রকৃত ধর্মরক্ষক’ আখ্যা দিয়ে এই বক্তারা হত্যার নৈতিক অনুমোদন দেন। সেই সঙ্গে একে ঈমানের প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করান। এর ফলে ভুক্তভোগীকে আইন ও মানবিকতার সুরক্ষাবলয়ের বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়। তাঁর মৃত্যু আর হত্যা হিসেবে বিবেচিত হয় না; বরং তা হয়ে ওঠে ন্যায্য শাস্তি। একই সঙ্গে সন্ত্রাসের বিচারকে রাষ্ট্রের আইনি ব্যবস্থার সমতুল্য, এমনকি কখনো তার চেয়েও উচ্চতর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

হানা আরেন্টের মূল যুক্তি হচ্ছে, মন্দ প্রায়ই চিন্তাহীনতার মধ্য দিয়েই কাজ করে। যখন কোনো কাজকে কর্তব্য হিসেবে দেখানো হয়, তখন মানুষ সেসবের পরিণতি নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দেয়। লাখ লাখ অনুসারী থাকা ধর্মীয় বক্তারা যখন প্রকাশ্যে এই হত্যার প্রশংসা করেন এবং তা পুনরাবৃত্তির আহ্বান জানান, তখন তাঁরা শুধু সহিংসতায় উসকানি দেন না; একই সঙ্গে তাঁদের সাগরেদদের ভাবার চর্চা বন্ধের প্রশিক্ষণ দেন। ব্যক্তিগত বিবেকের জায়গায় বসে যায় কল্পিত সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতি অন্ধ আনুগত্য।

দীপুকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার পর ফেসবুকে কয়েকজন ব্যক্তি লাইভে এসে এই হত্যাকাণ্ডকে উদযাপন করেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন জুবায়ের আহমেদ তাশরিফ, যাঁর ফেসবুকে অনুসারীর সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি এবং যিনি একজন সম্ভাব্য স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী।

আর ঠিক এখানেই ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের ‘হোমো স্যাকের’ ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রোমান যুগে ‘হোমো স্যাকের’ বলতে বোঝানো হতো এমন একজন মানুষকে, যাকে হত্যা করা যেত, কিন্তু সেই হত্যাকে খুন হিসেবে গণ্য করা হতো না। আগামবেন আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই ধারণা ব্যবহার করেন সেই সব মানুষকে বোঝাতে, যাদের জীবন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বহিষ্কার ও সহিংসতার মাধ্যমে রাজনৈতিক অধিকার ও আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমন মানুষদের হত্যা করা যায়, কিন্তু তা আর হত্যা হিসেবে বিবেচিত হয় না। কারণ, তারা এমন এক ব্যতিক্রমী পরিসরে অবস্থান করে, যেখানে স্বাভাবিক আইন কার্যকর নয়। ‘হোমো স্যাকের’-এর একটি নিদারুণ উদাহরণ হচ্ছে হাসিনা আমলে কথিত মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ক্রসফায়ারে খুন হওয়া শত শত বাংলাদেশি নাগরিক।

দীপুর মৃত্যু আমাদের দেখিয়ে দেয়, কীভাবে একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে ঠিক এই অবস্থায় ঠেলে দেওয়া যায়। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এখানে কাউকে ‘উনমানুষ’ বানানোর মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নৈতিক ও আইনি সমাজের বাইরে ছুড়ে ফেলে। একবার এই তকমা লাগলে, আগামবেনের ভাষায়, মানুষের জীবন পরিণত হয় ‘বেয়ার লাইফ’ বা ‘নগ্ন জীবন’-এ, যার জীবনের অর্থ কেবল বড়জোর একটি সংখ্যা হয়ে থাকতে পারে। জনতা এবং কিছু ধর্মীয় প্রচারকের তরফে এই হত্যাকাণ্ডের উদযাপনই সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ যে এই রূপান্তর ইতোমধ্যেই ঘটেছে, অথবা ঘটছে।

রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া বা এ ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত প্রতিক্রিয়ার অভাবই এ অবস্থাকে আরও গভীর করে তোলে। হত্যাকে ন্যায্যতা দেওয়া বয়ানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্র যখন দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয় না, তখন কার্যত সে এই ব্যতিক্রমের যুক্তিকেই মেনে নেয়। যদিও তদন্তে ধর্ম অবমাননার অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি, তবু এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ও চরম অবিচার জনমনে খুব বেশি ক্ষোভ সৃষ্টি করতে পারেনি। আরও দুঃখের কথা হচ্ছে, সহিংসতার মাত্রার সঙ্গে মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনো প্রচেষ্টারই সামঞ্জস্য নেই সমাজের তরফ থেকে। এই অসমতাই দেখিয়ে দেয়, কিছু নাগরিক কীভাবে জীবনের সুরক্ষার এক কোণে পড়ে থাকে।

আগামবেন সতর্ক করেছিলেন, আধুনিক রাষ্ট্রগুলো ক্রমশ এমন নিয়মের মাধ্যমেই আমাদের শাসন-পেষণ করে, যেখানে কিছু জনগোষ্ঠীকে কেবল নিয়ন্ত্রণ বা মুছে ফেলার উপকরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। সে অর্থে দীপুর হত্যা শুধু একটি অপরাধ নয়; বরং একধরনের রাজনৈতিক ইঙ্গিত যে কে এই সমাজে সত্যিকার অর্থে অন্তর্ভুক্ত, আর কে নয়।

যখন ঘৃণা এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, তখন ফলাফল স্রেফ বিশৃঙ্খলায় গিয়েই না থেকে বরং ভীতিকর সাম্যাবস্থা তৈরি করে। সহিংসতা আগে থেকেই অনুমানযোগ্য হয়ে উঠতে থাকে, আর অভিযোগ পরিণত হয় মূলত ক্ষমতার অস্ত্রে। নৈতিক পরিসর সংকুচিত হয়ে যায়; সন্দেহ, সহমর্মিতা ও বহুত্ববাদের জায়গা ক্রমেই কমে আসে। যা কথাবার্তা হিসেবে শুরু হয়, একসময় তা সামাজিক কাঠামোতে রূপ নেয়। ঘৃণা তখন আর আবেগ থাকে না, তা হয়ে ওঠে একটি ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দীপুর হত্যাকে হয়তো ভবিষ্যতে একটি মানবিক ট্র্যাজেডির চেয়ে বেশি স্মরণ করা হবে একটি নজির হিসেবে।

অনলাইনে ভবিষ্যতে এমন হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তির আহ্বানই দেখিয়ে দেয়, কীভাবে স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয়। আর এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায়। কারণ এটি জানান দেয় যে সমাজের ‘নৈতিক ব্রেক’ পুরোপুরি বিকল হয়ে গেছে। একটি সমাজ যখন এই অবস্থায় পৌঁছে যায়, তখন এটিকে পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা অসম্ভব না হলেও অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। এর জন্য শুধু অপরাধীদের শাস্তি দিলেই যথেষ্ট নয়। আমাদের ভেঙে ফেলতে হবে সেই বয়ান, সেই কর্তৃত্ব এবং সেই সামাজিক নীরবতাকেও, যা এই সহিংসতাকে সম্ভব করে তুলেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত