সেদিন ফেসবুক ঘাঁটতে গিয়ে একটি গ্রুপ চোখে পড়ল, নাম ‘আনরেডি আপুদের ছবি’। গ্রুপে গিয়ে দেখলাম, বিনা অনুমতিতে বিভিন্ন বয়সী নারীর ছবি তুলে পোস্ট করা হচ্ছে। একটি ছবিতে দেখা গেল, বাসে বসে থাকা এক তরুণী ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে আছেন, গায়ের ওপর থেকে ওড়না খানিকটা সরে গেছে; আরেক ছবিতে ওষুধের দোকানে বোরকা ও হিজাব পরা এক তরুণীর ছবি পেছন থেকে তোলা হয়েছে।
একবার এমন গ্রুপে ঢোকার পর অ্যালগরিদমের কল্যাণে টাইমলাইনে দেখা গেল একই ধাঁচের আরও বেশ কিছু গ্রুপের সাজেশন। উদ্দেশ্য এক—বিভিন্ন ‘আপুদের’ এমন মুহূর্তের ছবি পোস্ট করা, যখন তাঁরা নিজে বুঝতেই পারেননি যে তাঁদের ছবি তোলা হচ্ছে। ছবির নিচে অসংখ্য মন্তব্য, যার বেশির ভাগই নারীর শরীর, সৌন্দর্য ও ব্যক্তিকে নিয়ে আপত্তিকর এবং বিকৃত রুচির কথাবার্তা। হাজার হাজার গ্রুপ মেম্বার। কেউ পোস্ট করছেন, কেউ দেখছেন, কেউ লাইক-শেয়ার করছেন। ছবিতে নারী যত বেশি ‘অসতর্ক’, তত বেশি রিয়্যাকশন।
সাইবার জগতে নারী কতটা নিরাপদ? প্রশ্নটি নতুন নয়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) একটি গবেষণা বলছে, অনলাইনে অপদস্থ করা, বিনা অনুমতিতে ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি অথবা ভিডিও ব্যবহার করা, অজ্ঞাতে কারও ওপর নজর রাখা—এসব ডিজিটাল সহিংসতার প্রধান টার্গেট নারীরাই। অথচ নারীকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিরাপত্তা দেওয়ার মতো শক্তিশালী আইন, মনিটরিং বা রিপোর্টিং কাঠামো এখনো দুর্বল।
ফলাফল? নারীকে টার্গেট করার নতুন নতুন ডিজিটাল প্রথা গড়ে উঠছে। যেমন ফেসবুক গ্রুপ, ইনস্টাগ্রামের ভুয়া অ্যাকাউন্ট, টেলিগ্রাম চ্যানেল, এমনকি এআই-জেনারেটেড ডিপফেক।
যখন সাইবার জগৎ বা সোশ্যাল মিডিয়া এতটা জনপ্রিয় ছিল না, তখনো নারী সহিংস আচরণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হেনস্থাকারীরাও ডিজিটাল মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে। পাড়া-মহল্লার চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ানো উত্ত্যক্তকারীরা এখন নেটিজেনে ‘আপগ্রেড’ হয়েছেন। ঘরে বসে স্ক্রল করলেই যখন হাজারো নারীর ডিজিটাল উপস্থিতি চোখের সামনে চলে আসে, তখন বাইরে গিয়ে উত্ত্যক্ত করার দরকারই বা কী? নিরাপদ দূরত্বে থেকে পরিচয় লুকিয়ে এখন আরও সহজে নারীকে টার্গেট করা সম্ভব হচ্ছে।
নারী সেলিব্রিটি বা ইনফ্লুয়েন্সার হলে তো কথাই নেই। তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, বয়স, পারিবারিক সম্পর্ক—সবকিছু যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘পাবলিক প্রপার্টি’ হয়ে যায়। ফেসবুকে সাম্প্রতিক আলোড়ন তোলা বিষয়গুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, অমুক অভিনেত্রীর প্রকৃত বয়স, তমুক নারী উদ্যোক্তার তৃতীয় স্বামী, অমুক শিল্পীর বিবাহবিচ্ছেদ—সবই কতটা আগ্রহ ও কৌতূহল সৃষ্টি করে। নারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও এর বাইরে নন। তাঁদের সম্পর্কে প্রকৃত অভিযোগ বাদ দিয়ে নারী হিসেবে তাঁদের চরিত্রহননের পথটাই অনেকে বেছে নিচ্ছেন। এআই দিয়ে নারী নেত্রীদের আপত্তিকর ছবি-ভিডিও বানানোর এই ভয়াবহ প্রথা আমরা সবাই কমবেশি দেখেছি।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ট্রল, বুলিং আর ‘মিডিয়া ট্রায়াল’। দেখা যায়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর প্রকাশ করা তথ্যই তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রাচীন চর্যাপদের কবির ভাষায়, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’, অর্থাৎ নিজের মাংসই হরিণের সবচেয়ে বড় শত্রু। যুগ বদলালেও নারীদের ক্ষেত্রে কথাটি আজও অনেকাংশে সত্য। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারীকে রক্তমাংসে পাওয়া না গেলেও তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি, স্ট্যাটাস, সম্পর্ক—সবই পরিণত হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত নতুন ‘মাংসে’। ডেটা প্রাইভেসি রক্ষার বাধ্যবাধকতা নেই বললেই চলে। ফলে নারীর নাম, পরিচয়, বৈবাহিক অবস্থাসহ সম্পর্ক—সবই অসুস্থ কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।
নেটফ্লিক্সের ‘হোয়াটস নেক্সট? দ্য ফিউচার উইথ বিল গেটস’ সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তথ্যের প্রাদুর্ভাব এবং মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যদিও এখানে সরাসরি নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয় উঠে আসেনি, তবু এতে আরও বড় একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে—সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, তা তথ্যকে দ্রুত ছড়িয়ে দেয় এবং মিথ্যা বা বিকৃত তথ্যের পরিবাহক হিসেবে কাজ করে। এর ফলে ব্যক্তিগত তথ্যের লঙ্ঘন, গোপনীয়তার হানিসহ নারীর অধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
নারীর প্রতি ডিজিটাল সহিংসতা শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, এটি আমাদের সামাজিক ও নৈতিক কাঠামোর ভয়াবহ সংকটের প্রতিচ্ছবি। প্রশ্ন হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কি সত্যিই মানুষকে সংযুক্ত করছে? নাকি কাউকে টার্গেটে পরিণত করার অদৃশ্য অস্ত্র হয়ে উঠছে? আমরা যদি এই ‘ভাইরাল সংস্কৃতি’কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তবে অনলাইন আক্রমণ একধরনের ডিজিটাল মহামারিতে রূপ নেবে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যে কেউ, বিশেষত নারীরা যেকোনো মুহূর্তে এর শিকার হতে পারেন। তাই এখনই দরকার শক্তিশালী আইনি কাঠামো, সামাজিক সচেতনতা এবং প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা—যাতে ডিজিটাল জগৎ ভয় নয়, স্বাধীনতা ও সম্মানের জায়গা হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: গবেষক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ