আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একটি গভীর নৈরাজ্য ও বৈষম্যমূলক কাঠামোতে পরিণত হয়েছে, যা জাতির ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এর মূল কারণগুলো হলো—আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, বাস্তবায়িত না হওয়া শিক্ষানীতি, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন এবং নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সংযোগহীনতা। জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে পরীক্ষাপাসের সংস্কৃতি একটি ভিত্তিহীন প্রজন্ম তৈরি করছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি অভিন্ন, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং শিক্ষকদের মর্যাদা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
আনু মুহাম্মদ

সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে পাশের হার উচ্চহারে কমে যাওয়াটা ২১ বছরের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। তবে শিক্ষা উপদেষ্টার মতে, এটিই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র। এই মন্তব্যটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা সাময়িক ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করে না, বরং এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা এক গভীর নৈরাজ্য এবং নীতিগত পঙ্গুত্বের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ কেবল সংকটে নয়, এটি একটি নৈরাজ্যিক কাঠামোতে পরিণত হয়েছে, যা পদ্ধতিগতভাবে বৈষম্য তৈরি করছে এবং জাতির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আমাদের সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি খণ্ডিত ও বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। একই দেশের সীমানার মধ্যে একটি শিশু জন্মের পর অসংখ্য শিক্ষাধারার মুখোমুখি হয়, যা পৃথিবীতে বিরল। একদিকে রয়েছে কিন্ডারগার্টেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ব্যয়বহুল বেসরকারি ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম স্কুল; অন্যদিকে রয়েছে আলিয়া, কওমি, ক্যাডেটসহ বিভিন্ন ধারার মাদ্রাসা এবং এনজিও পরিচালিত স্কুল।
এই বিভাজন কেবল পাঠ্যক্রম বা শিক্ষাদানের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সরাসরি শিক্ষার্থীর আর্থ-সামাজিক অবস্থানের সাথে জড়িত। একজন অভিভাবকের আর্থিক সামর্থ্যই নির্ধারণ করে দেয় তার সন্তান কোন মানের শিক্ষা পাবে। ব্যয়বহুল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীর সুযোগের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। এই কাঠামো শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বদলে পণ্যে পরিণত করেছে এবং শৈশব থেকেই সমাজে বৈষম্যের বীজ বপন করছে। কোনো সরকারই এখন পর্যন্ত একটি অভিন্ন, মানসম্মত ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারেনি, যা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব ছিল।
২০১০ সালে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও, দেড় দশক পরেও তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এর পরিবর্তে, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো সংস্থার নির্দেশনায় বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে, যা মূল সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ। পাঠ্যক্রমের ঘন ঘন পরিবর্তন এবং সমন্বয়হীনতা শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে, কিন্তু শিক্ষার মানে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসেনি।
এর চেয়েও ভয়াবহ চিত্র শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পৃথিবীর সর্বনিম্ন স্তরের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও তা লজ্জাজনকভাবে কম। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যখন রাস্তায় নেমে ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়ার মতো সামান্য দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করেন, তখন বোঝা যায় আমরা শিক্ষাগুরুদের কোন মর্যাদার আসনে রেখেছি। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ খালি, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অপ্রতুল এবং তাদের কোনো সামাজিক বা আর্থিক নিরাপত্তা নেই। যে জাতি তার শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও সম্মানী দিতে পারে না, সে জাতির কাছ থেকে একটি শিক্ষিত ও দক্ষ প্রজন্ম আশা করা বাতুলতা মাত্র।
সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়টিও এখানে স্পষ্ট। যখন শিক্ষকদের সামান্য দাবি পূরণের ক্ষেত্রে অর্থ সংকটের কথা বলা হয়, তখন অস্ত্র ক্রয়, বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি বা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হতে দেখা যায়। এই দ্বিমুখী নীতি প্রমাণ করে যে, শিক্ষা খাত সরকারের কাছে অগ্রাধিকার তালিকায় নেই।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই বেহাল দশার অন্যতম প্রধান কারণ হলো, দেশের নীতিনির্ধারক, আমলা এবং প্রভাবশালী শ্রেণীর সঙ্গে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার কোনো সংযোগ নেই। তাদের সন্তানরা দেশের সরকারি স্কুল, কলেজ বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না। তারা হয় দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে, নয়তো বিদেশে পাড়ি জমায়। ফলে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও তাদের জীবনে এর কোনো আঁচ লাগে না।
যদি এমন একটি নিয়ম থাকত যে, সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সন্তানদের দেশের পাবলিক প্রতিষ্ঠানে পড়তেই হবে, তাহলে হয়তো রাতারাতি এই ব্যবস্থার চিত্র বদলে যেত। কারণ তখন তারা নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ব্যবস্থার উন্নয়নে মনোযোগী হতেন। কিন্তু এই সংযোগহীনতার কারণে তারা সাধারণ মানুষের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। তাদের কাছে শিক্ষাব্যবস্থা একটি দূরবর্তী সমস্যা, যার সমাধান তাদের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না।
সমান্তরালভাবে, দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এর পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, বিভিন্ন সরকার রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটি শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য একটি সহজলভ্য বিকল্প। আবাসিক ব্যবস্থা থাকায় এবং খরচ কম হওয়ায় অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠাতে বাধ্য হয়, যেখানে সাধারণ স্কুলগুলোতে খরচ এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক দায়িত্ব অনেক বেশি। তাদের কাছে এটি সন্তানকে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার পাশাপাশি ন্যূনতম জীবন-জীবিকার একটি নিশ্চয়তাও বটে।
কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফল সমাজের জন্য উদ্বেগজনক। একটি বিশাল জনগোষ্ঠী মূলধারার বিজ্ঞান, গণিত ও ভাষা শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এর ফলে কর্মসংস্থানের বাজারে যেমন তারা পিছিয়ে পড়ছে, তেমনি সমাজের মধ্যে একটি আদর্শিক বিভাজনও তীব্র হচ্ছে। যখন এই বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থানের দাবি ওঠে, তখন পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার মতো দাবি সামনে আসে, যা শিক্ষাকে আরও বেশি বিভাজিত করে তোলে। একটি অভিন্ন কাঠামোর মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষাকে একটি বিশেষায়িত শাখা হিসেবে রাখার সুযোগ থাকলেও, তা না করে দুটি সমান্তরাল ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যা সামাজিক সম্প্রীতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
এই বিশৃঙ্খল ব্যবস্থার চূড়ান্ত শিকার হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। তারা ভাষা, বিজ্ঞান বা গণিতের মতো মৌলিক বিষয়ে একটি শক্ত ভিত্তি ছাড়াই উচ্চতর শিক্ষার ধাপে প্রবেশ করছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে কেবল পরীক্ষাপাসের একটি কারখানায় পরিণত হয়েছে। কোচিং সেন্টার এবং প্রাইভেট টিউশনির ওপর নির্ভরশীলতা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। পরীক্ষার ফল দিয়ে শিক্ষার মান বিচার করার একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল, যা এবারের এইচএসসি ফলাফলে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। যথাযথভাবে খাতা মূল্যায়ন করা হলে পাশের হার হয়তো আরও কমত। এর জন্য শিক্ষার্থী বা এককভাবে শিক্ষকরা দায়ী নন; দায়ী এই পুরো ব্যবস্থা, যা ভেতর থেকে ক্ষয়ে গেছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু লোক দেখানো সংস্কার যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন একটি আমূল পরিবর্তন। প্রথমত, একটি অভিন্ন, বৈষম্যহীন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা একটি ঐচ্ছিক বা বিশেষায়িত বিষয় হিসেবে থাকবে। দ্বিতীয়ত, জিডিপির কমপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে, যা একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। সবশেষে, নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই এই ব্যবস্থার অংশীদার হতে হবে।
৫৪ বছরের বাংলাদেশে অনেক সরকার এসেছে, কিন্তু শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সদিচ্ছা কারো মধ্যেই দেখা যায়নি। শিক্ষা এখন আর কেবল একটি খাত নয়, এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। একটি দুর্বল ও বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অসম্ভব। তাই এখনই সময়, সকল প্রকার রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে একটি শিক্ষিত, দক্ষ ও মানবিক প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। নইলে আমাদের জনসম্পদই একদিন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক

সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে পাশের হার উচ্চহারে কমে যাওয়াটা ২১ বছরের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। তবে শিক্ষা উপদেষ্টার মতে, এটিই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র। এই মন্তব্যটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা সাময়িক ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করে না, বরং এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা এক গভীর নৈরাজ্য এবং নীতিগত পঙ্গুত্বের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ কেবল সংকটে নয়, এটি একটি নৈরাজ্যিক কাঠামোতে পরিণত হয়েছে, যা পদ্ধতিগতভাবে বৈষম্য তৈরি করছে এবং জাতির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আমাদের সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি খণ্ডিত ও বহুধা বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। একই দেশের সীমানার মধ্যে একটি শিশু জন্মের পর অসংখ্য শিক্ষাধারার মুখোমুখি হয়, যা পৃথিবীতে বিরল। একদিকে রয়েছে কিন্ডারগার্টেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ব্যয়বহুল বেসরকারি ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম স্কুল; অন্যদিকে রয়েছে আলিয়া, কওমি, ক্যাডেটসহ বিভিন্ন ধারার মাদ্রাসা এবং এনজিও পরিচালিত স্কুল।
এই বিভাজন কেবল পাঠ্যক্রম বা শিক্ষাদানের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সরাসরি শিক্ষার্থীর আর্থ-সামাজিক অবস্থানের সাথে জড়িত। একজন অভিভাবকের আর্থিক সামর্থ্যই নির্ধারণ করে দেয় তার সন্তান কোন মানের শিক্ষা পাবে। ব্যয়বহুল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষার্থীর সুযোগের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। এই কাঠামো শিক্ষাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার বদলে পণ্যে পরিণত করেছে এবং শৈশব থেকেই সমাজে বৈষম্যের বীজ বপন করছে। কোনো সরকারই এখন পর্যন্ত একটি অভিন্ন, মানসম্মত ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারেনি, যা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব ছিল।
২০১০ সালে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও, দেড় দশক পরেও তা পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এর পরিবর্তে, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো সংস্থার নির্দেশনায় বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে, যা মূল সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ। পাঠ্যক্রমের ঘন ঘন পরিবর্তন এবং সমন্বয়হীনতা শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে, কিন্তু শিক্ষার মানে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসেনি।
এর চেয়েও ভয়াবহ চিত্র শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পৃথিবীর সর্বনিম্ন স্তরের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও তা লজ্জাজনকভাবে কম। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যখন রাস্তায় নেমে ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়ার মতো সামান্য দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করেন, তখন বোঝা যায় আমরা শিক্ষাগুরুদের কোন মর্যাদার আসনে রেখেছি। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ খালি, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অপ্রতুল এবং তাদের কোনো সামাজিক বা আর্থিক নিরাপত্তা নেই। যে জাতি তার শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও সম্মানী দিতে পারে না, সে জাতির কাছ থেকে একটি শিক্ষিত ও দক্ষ প্রজন্ম আশা করা বাতুলতা মাত্র।
সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়টিও এখানে স্পষ্ট। যখন শিক্ষকদের সামান্য দাবি পূরণের ক্ষেত্রে অর্থ সংকটের কথা বলা হয়, তখন অস্ত্র ক্রয়, বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি বা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হতে দেখা যায়। এই দ্বিমুখী নীতি প্রমাণ করে যে, শিক্ষা খাত সরকারের কাছে অগ্রাধিকার তালিকায় নেই।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই বেহাল দশার অন্যতম প্রধান কারণ হলো, দেশের নীতিনির্ধারক, আমলা এবং প্রভাবশালী শ্রেণীর সঙ্গে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার কোনো সংযোগ নেই। তাদের সন্তানরা দেশের সরকারি স্কুল, কলেজ বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না। তারা হয় দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে, নয়তো বিদেশে পাড়ি জমায়। ফলে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও তাদের জীবনে এর কোনো আঁচ লাগে না।
যদি এমন একটি নিয়ম থাকত যে, সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সন্তানদের দেশের পাবলিক প্রতিষ্ঠানে পড়তেই হবে, তাহলে হয়তো রাতারাতি এই ব্যবস্থার চিত্র বদলে যেত। কারণ তখন তারা নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ব্যবস্থার উন্নয়নে মনোযোগী হতেন। কিন্তু এই সংযোগহীনতার কারণে তারা সাধারণ মানুষের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। তাদের কাছে শিক্ষাব্যবস্থা একটি দূরবর্তী সমস্যা, যার সমাধান তাদের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না।
সমান্তরালভাবে, দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এর পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, বিভিন্ন সরকার রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটি শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য একটি সহজলভ্য বিকল্প। আবাসিক ব্যবস্থা থাকায় এবং খরচ কম হওয়ায় অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠাতে বাধ্য হয়, যেখানে সাধারণ স্কুলগুলোতে খরচ এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক দায়িত্ব অনেক বেশি। তাদের কাছে এটি সন্তানকে একটি নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার পাশাপাশি ন্যূনতম জীবন-জীবিকার একটি নিশ্চয়তাও বটে।
কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফল সমাজের জন্য উদ্বেগজনক। একটি বিশাল জনগোষ্ঠী মূলধারার বিজ্ঞান, গণিত ও ভাষা শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এর ফলে কর্মসংস্থানের বাজারে যেমন তারা পিছিয়ে পড়ছে, তেমনি সমাজের মধ্যে একটি আদর্শিক বিভাজনও তীব্র হচ্ছে। যখন এই বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থানের দাবি ওঠে, তখন পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার মতো দাবি সামনে আসে, যা শিক্ষাকে আরও বেশি বিভাজিত করে তোলে। একটি অভিন্ন কাঠামোর মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষাকে একটি বিশেষায়িত শাখা হিসেবে রাখার সুযোগ থাকলেও, তা না করে দুটি সমান্তরাল ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যা সামাজিক সম্প্রীতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
এই বিশৃঙ্খল ব্যবস্থার চূড়ান্ত শিকার হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। তারা ভাষা, বিজ্ঞান বা গণিতের মতো মৌলিক বিষয়ে একটি শক্ত ভিত্তি ছাড়াই উচ্চতর শিক্ষার ধাপে প্রবেশ করছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন জ্ঞানার্জনের পরিবর্তে কেবল পরীক্ষাপাসের একটি কারখানায় পরিণত হয়েছে। কোচিং সেন্টার এবং প্রাইভেট টিউশনির ওপর নির্ভরশীলতা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। পরীক্ষার ফল দিয়ে শিক্ষার মান বিচার করার একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল, যা এবারের এইচএসসি ফলাফলে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। যথাযথভাবে খাতা মূল্যায়ন করা হলে পাশের হার হয়তো আরও কমত। এর জন্য শিক্ষার্থী বা এককভাবে শিক্ষকরা দায়ী নন; দায়ী এই পুরো ব্যবস্থা, যা ভেতর থেকে ক্ষয়ে গেছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু লোক দেখানো সংস্কার যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন একটি আমূল পরিবর্তন। প্রথমত, একটি অভিন্ন, বৈষম্যহীন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা একটি ঐচ্ছিক বা বিশেষায়িত বিষয় হিসেবে থাকবে। দ্বিতীয়ত, জিডিপির কমপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে, যা একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। সবশেষে, নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই এই ব্যবস্থার অংশীদার হতে হবে।
৫৪ বছরের বাংলাদেশে অনেক সরকার এসেছে, কিন্তু শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সদিচ্ছা কারো মধ্যেই দেখা যায়নি। শিক্ষা এখন আর কেবল একটি খাত নয়, এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। একটি দুর্বল ও বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা অসম্ভব। তাই এখনই সময়, সকল প্রকার রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে একটি শিক্ষিত, দক্ষ ও মানবিক প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। নইলে আমাদের জনসম্পদই একদিন বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক

২০০৭ সালের ‘ওয়ান-ইলেভেন’ থেকে ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং তৎপরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রার একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ এই লেখা। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের অভাব, আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতার সংকট এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে সৃষ্ট সামাজিক ক্ষত ত
৯ ঘণ্টা আগে
ঢাকার ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গত ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভিন্ন আবহে পালিত হয় ৫৪তম মৈত্রী দিবস। এতে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে স্থিতিশীল, ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক চায়।
১ দিন আগেবাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত বার্ষিক ডেভেলপমেন্ট কনফারেন্সের এবারের আলোচনার শিরোনাম ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন’, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। আমরা সবাই এখন এই বিষয়টি নিয়েই ভাবছি।
১ দিন আগে
পেরুর বিচারক লুজ দেল কারমেন ইবানিয়েজ কারাঞ্জর ওপর গত জুনে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। কারণ, তিনি ২০০৩ সালের পর আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অপরাধ তদন্তের অনুমতি দিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে গত এক বছরে ছয়জন আইসিসি বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
২ দিন আগে