leadT1ad

আনু মুহাম্মদের কলাম/বাংলাদেশ একটা বন্দরও চালাতে পারে না, এটা তো গ্রহণযোগ্য হবে না

স্ট্রিম গ্রাফিক

সম্প্রতি অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো ও অস্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল পরিচালনার জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গত সোমবার (১৭ নভেম্বর) ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য ডেনমার্কের ‘এপিএম টার্মিনালস’ এবং কেরানীগঞ্জের পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য সুইজারল্যান্ডের ‘মেডলগ এসএ’-এর সঙ্গে চুক্তিগুলো সম্পন্ন হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, দুর্নীতি রোধ এবং বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হলেও, পুরো প্রক্রিয়াটি জন্ম দিয়েছে গভীর সন্দেহ ও জাতীয় স্বার্থ নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ।

সরকার প্রধানত তিনটি যুক্তি সামনে এনেছে—বিদেশি বিনিয়োগ, দুর্নীতি দমন এবং দক্ষতা বৃদ্ধি। নৌপরিবহন উপদেষ্টা বলেছেন, এই চুক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জন্য বড় একটি অবদান। তাঁর মতে, বিদেশি কোম্পানি এলে দুর্নীতি হবে না এবং বন্দরের সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এসব যুক্তির সঙ্গে সরকারের কর্মকাণ্ডের অসংগতি অত্যন্ত প্রকট। প্রথমত, যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এবং যে তাড়াহুড়ো করে চুক্তিটি করা হয়েছে, তা স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের উদ্রেক করে। দ্বিতীয়ত, চুক্তির শর্তাবলি জনসমক্ষে প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত এই প্রক্রিয়াকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য গঠিত সরকারের এমন লুকোচুরি জাতির কাছে ভুল বার্তা দেয়।

বিদেশি বিনিয়োগ একটি দেশের উন্নয়নের কাজে লাগবে যদি তা হয় দেশের স্বার্থ রক্ষা করে। রামপাল, মাতারবাড়ী, বাঁশখালী, পায়রা বা রূপপুরের মতো প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে, তাতো আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে করা চুক্তি নিয়েও অনেক সমস্যা। তাই নতুন করে কোনো বিদেশি বিনিয়োগের আগে তার শর্তগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি ছিল, যা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত।

নিউমুরিং টার্মিনাল ও মাশুল বৃদ্ধি: জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী?

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে বিদেশি কোম্পানি আনা জরুরি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান না করেই সরকার নিজেদের পছন্দে আবুধাবির একটি কোম্পানিকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

এর পেছনে সরকারের যুক্তি হলো, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান এবং তারা দুর্নীতি রোধ করে দক্ষতা বাড়াবে। কিন্তু এই যুক্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। বিদেশি কোম্পানির উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করতে সরকার বন্দরের মাশুল প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। এরকম অযৌক্তিকভাবে মাশুল বৃদ্ধি দুর্নীতিরই একটি ভিন্ন রূপ, যার মাধ্যমে দেশের জনগণের পকেট থেকে অর্থ নিয়ে বিদেশি কোম্পানির কোষাগার ভর্তি করা হবে।

সরকারের যুক্তি অনুসারে, দুর্নীতি দূর করতে বিদেশি কোম্পানি আনা হচ্ছে, তাহলে মন্ত্রণালয়গুলো তো দুর্নীতির আখড়া, তাহলে সেগুলোও কি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে?

সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার হলো, বন্দরের উন্নয়নের জন্যই মাশুল বৃদ্ধি এবং এই বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। অথচ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বর্তমানে একটি অত্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এর যা খরচ হয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ লাভ থাকে। অর্থাৎ, সক্ষমতা বৃদ্ধি বা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বন্দরের নিজস্ব তহবিল থেকেই জোগান দেওয়া সম্ভব। তাহলে কেন এই মাশুল বৃদ্ধি এবং কেনই বা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার এই আয়োজন? এর একমাত্র উত্তর হতে পারে—বিদেশি লবিস্ট ও কমিশনভোগীদের স্বার্থ রক্ষা করা। প্রকৃতপক্ষে বন্দরের সমস্যা ও দুর্বল সক্ষমতার মূল কারণ কাস্টমস ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এই দুটি জায়গার সংস্কার না করে শুধু অপারেটর পরিবর্তন করলে দক্ষতা বাড়বে—এই প্রচারণাটিও সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক।

জাতীয় সক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এসে যদি বলা হয়, বাংলাদেশ একটি বন্দরও দক্ষভাবে পরিচালনা করতে পারে না, তবে তা জাতির জন্য চরম লজ্জাজনক। দেশে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকার পরও যদি বন্দর পরিচালনার জন্য বিদেশি দক্ষতার ওপর নির্ভর করতে হয়, তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং জাতীয় সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সরকারের যুক্তি অনুসারে, দুর্নীতি দূর করতে বিদেশি কোম্পানি আনা হচ্ছে, তাহলে মন্ত্রণালয়গুলো তো দুর্নীতির আখড়া, তাহলে সেগুলোও কি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে?

এই ধরনের হীনম্মন্যতামূলক যুক্তি দিয়ে জাতীয় সক্ষমতাকে জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে। একটি দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মূল ভিত্তি হলো তার আত্মমর্যাদা ও জাতীয় সক্ষমতার ওপর আস্থা। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব ছিল বন্দরের দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে তা দূর করার পথনির্দেশ করা এবং জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ তৈরি করা। কিন্তু সরকার সেই পথে না হেঁটে উল্টো বিদেশি কোম্পানির হাতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্থাপনা তুলে দিয়ে আগামী ৩০-৪০ বছরের জন্য বাংলাদেশকে একটি বিপজ্জনক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

প্রক্রিয়াগত ত্রুটি ও অন্তর্বর্তী সরকারের এখতিয়ার

একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া। তাদের কোনো আইনগত বা নৈতিক অধিকার নেই দেশের ভবিষ্যৎকে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাবিত করে এমন কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করার। এই চুক্তিগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংসদেই কেবল এ ধরনের চুক্তির শর্তাবলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে।

বন্দরের সমস্যা ও দুর্বল সক্ষমতার মূল কারণ কাস্টমস ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এই দুটি জায়গার সংস্কার না করে শুধু অপারেটর পরিবর্তন করলে দক্ষতা বাড়বে—এই প্রচারণাটিও সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক।

তাছাড়া, কোনো আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান না করে, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে, সম্পূর্ণ অস্বচ্ছভাবে এই চুক্তিগুলো করা হয়েছে। কেন একটি অস্বাভাবিক দিনকে (এদিন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বেছে নেওয়া হলো, তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। যদি চুক্তিটি সত্যিই দেশের স্বার্থে হতো, তবে তা প্রকাশ্যে, সব শর্ত জানিয়ে এবং জনগণের মতামত নিয়ে করা যেত। এই লুকোচুরি প্রমাণ করে যে, এতে বড় সমস্যা আছে, দেশের মানুষকে সব জানতে দেওয়া যাবে না।

সবশেষে বলা যায় এই বন্দর চুক্তিগুলো বিদেশি বিনিয়োগ আনার নামে প্রকৃতপক্ষে দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া বলেই মনে হয়। এটি জাতীয় সক্ষমতাকে অপমান করার পাশাপাশি আগামী ৩০-৪০ বছরের জন্য দেশের অর্থনীতিকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যখন এই চুক্তির নেতিবাচক প্রভাবগুলো স্পষ্ট হবে, তখন আজকের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কাউকেই জবাবদিহি করার জন্য পাওয়া যাবে না।

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা একটি সরকারের কাছ থেকে দেশের মানুষ এমনটি প্রত্যাশা করে না। তাদের দায়িত্ব ছিল দুর্নীতির মূলোৎপাটন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পথ তৈরি করা, পাইকারি হারে জোরজবরদস্তি করে জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া নয়। এই চুক্তি বিদেশি লবিস্ট ও তাদের দেশীয় সহযোগীদের বিজয় হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের জন্য এটি একটি বড় পরাজয়। এর পুরো দায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে।

আনু মুহাম্মদ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

Ad 300x250

সম্পর্কিত