অভিনব মেহরোত্রা

জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। গত ১৭ নভেম্বরের এই রায়ের বিপরীতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ অস্পষ্ট ও রহস্যজনক। এক সময়ের মিত্রের বিরুদ্ধে দেওয়া রায় ‘আমলে নিয়ে’ নয়াদিল্লি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা ‘সব অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত’ থাকবে।
তিন সপ্তাহ পরে ঢাকার অনুরোধে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের অবস্থান ছিল আরও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি ফেরার বিষয়টি পুরোপুরি শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টার মূলে রয়েছে প্রায় এক যুগ আগে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি।
ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে গত ২১ নভেম্বর শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছে। এ নিয়ে ভারত এখন কূটনৈতিক উভয় সংকটে পড়েছে। রায় ও প্রত্যর্পণ ইস্যু ভারত সরকারকে আইনি, নৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে।
ভারত সরকার ঢাকার অনুরোধ পর্যালোচনা করছে। ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার জোর দিয়ে বলছে, তাদের এই অনুরোধ দুদেশের মধ্যে ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের যুক্তি, এই চুক্তি অনুযায়ী গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত যেকোনো ব্যক্তিকে ফেরত দিতে ভারত বাধ্য, যদি তা পদ্ধতিগত মানদণ্ড পূরণ করে।
তবে ভারত সতর্কতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং এখনো কোনো ইঙ্গিত দেয়নি যে, তারা এই অনুরোধ গ্রহণ করবে, প্রত্যাখ্যান করবে, নাকি আরও ব্যাখ্যা চাইবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কোনো পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকে, তবে ভারত আইনগতভাবে প্রত্যর্পণ বিলম্বিত বা প্রত্যাখ্যান করার যৌক্তিকতা দেখাবে।
বাংলাদেশ যদি ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে চায়, সবার আগে তাঁকে সরকারিভাবে ‘পলাতক অপরাধী’ ঘোষণা করতে হবে। এরপর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, সেসব দুদেশের মধ্যে করা ‘প্রত্যর্পণ চুক্তিতে’ উল্লেখ আছে কিনা? উল্লেখ থাকলে তবেই ফেরত চাওয়া যাবে।
শেখ হাসিনার অপরাধের যাবতীয় প্রমাণ, আদালতের নথিসহ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘কনস্যুলার, পাসপোর্ট ও ভিসা (সিপিভি)’ বিভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জমা দিতে হবে। ভারতের ১৯৬২ সালের প্রত্যর্পণ আইন অনুযায়ী এসব যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া বেশ কঠোর। এখানে মামলার একটি শক্ত ‘প্রাথমিক ভিত্তি’ বা ‘প্রাইমা ফেসি’ প্রমাণ করা জরুরি। এর অর্থ হলো, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত প্রমাণ এতটাই জোরালো হতে হবে যে, একই ধরনের অপরাধ ভারতে সংঘটিত হলে, সেই প্রমাণের ভিত্তিতে সেখানে বিচারকাজ শুরু করা সম্ভব হয়।

তবে এই আইনের তৃতীয় অধ্যায়ে ‘দ্রুত’ বা সহজ প্রক্রিয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই নিয়মের অধীনে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধের শক্ত প্রাথমিক ভিত্তি বা ‘প্রাইমা ফেসি’ কেস দাঁড় করানোর বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে। পরিবর্তে, অনুরোধকারী দেশ (বাংলাদেশ) থেকে পাঠানো গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ নথিপত্র একজন প্রত্যর্পণ বিচারককে সন্তুষ্ট করলেই চলবে। বিচারককে নিশ্চিত হতে হবে, নথিপত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছে ও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ দুদেশের চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মধ্যে পড়ে।
ভারতের ১৯৬২ সালের আইনে আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণের আবেদন করার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাময়িক গ্রেপ্তার করার বিধান রয়েছে। তবে এই গ্রেপ্তারের অনুরোধ অবশ্যই কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিপিভি বিভাগে পাঠাতে হবে। এ কাজে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা বা ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া সম্ভব। যদিও শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এমন কোনো সাময়িক গ্রেপ্তারের অনুরোধ জানানো হয়নি।
আইন অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণের আবেদন জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধকারী রাষ্ট্রকে ৪৫ থেকে ৬০ দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হয়। যদি এই সময়ের মধ্যে স্বাগতিক দেশের আদালত পলাতক আসামিকে মুক্তিও দেয়, তবুও তা ভবিষ্যতে তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার বা প্রত্যর্পণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। অর্থাৎ, পরে যদি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র এসে পৌঁছায়, তবে অভিযুক্তকে আবার গ্রেপ্তার করে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া চালানো যাবে।
একজন পলাতক অপরাধীকে হস্তান্তরের অনুরোধ কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে করা যেতে পারে; যেমন– দিল্লিতে অবস্থিত কোনো কূটনীতিকের মাধ্যমে, সরাসরি অনুরোধকারী সরকারের মাধ্যমে অথবা বিদেশের ভারতীয় মিশনের মাধ্যমে।
সিপিভি বিভাগ প্রত্যর্পণের অনুরোধ পাওয়ার পর যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যায়। যদি অনুরোধ উপযুক্ত মনে করা হয়, তবে মামলা তদন্তের জন্য একজন তদন্ত বিচারক নিয়োগ করা যেতে পারে। যখন পলাতকের পরিচয়, সমর্থনকারীর প্রমাণাদী, আইনের বিধান ও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হস্তান্তরের বিষয়ে তদন্ত বিচারকের প্রতিবেদন পরীক্ষা করা হয়, তখন প্রত্যর্পণ বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠাতে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। এই পর্যায়ে প্রত্যর্পণ বিচারক তাঁর প্রতিবেদন ও পলাতক অপরাধীর লিখিত বিবৃতি থাকলে তা কেন্দ্রীয় সরকারের বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দেন।
তদন্ত শেষ করার পর যদি প্রত্যর্পণ বিচারক দেখতে পান, বিদেশি রাষ্ট্রের অনুরোধ অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান মামলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে পলাতক অপরাধীকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। তদন্ত প্রতিবেদন ও পলাতক আসামির জবানবন্দি যাচাই-বাছাই করার পর সরকার তাঁকে ফেরত পাঠানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এজন্য সরকার আসামিকে হেফাজতে নেওয়া ও হস্তান্তরের জন্য পরোয়ানা জারি করতে পারে। এই পরোয়ানায় স্পষ্ট উল্লেখ থাকে, ঠিক কোন স্থানে ও কার কাছে আসামিকে তুলে দেওয়া হবে।
স্বাগতিক রাষ্ট্র চাইলে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। যদি তারা মনে করে, অপরাধের ধরন রাজনৈতিক বা সামরিক প্রকৃতির অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তি অনুরোধকারী দেশে বিচার বা শাস্তি থেকে দায়মুক্ত, তবে তাঁকে ফেরত পাঠাবে না। এছাড়া অভিযুক্ত যদি আগেই ওই অপরাধের জন্য বিচার বা শাস্তি পেয়ে থাকেন কিংবা খালাস বা ক্ষমা পেয়ে থাকেন, তাহলেও প্রত্যর্পণ করা হবে না। এমনকি যদি মনে হয় অভিযুক্তকে তাঁর বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, জাতীয়তা বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশে ফেরত চাওয়া হচ্ছে, তবে স্বাগতিক রাষ্ট্র এই অনুরোধ নাকচ করতে পারে।
অবশ্য অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি তদন্ত বিচারকের কাছে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়ে দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হতে বা শাস্তি মেনে নিতে রাজি হন, তাঁকে প্রত্যর্পণ করা সহজ। কিন্তু এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠানোর আগে বিচারককে ‘দ্বৈত অপরাধ’ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, যে অপরাধের জন্য ফেরত চাওয়া হচ্ছে, তা বাংলাদেশ ও ভারত– উভয় দেশের আইনের চোখে অপরাধ।
প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ার একদম শেষ ধাপে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তদন্ত বিচারকের সুপারিশ পাওয়ার পর সরকার যদি আসামিকে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়, তখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিদেশি মিশন হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ঠিক করবে। এরপর অনুরোধকারী দেশের একজন এসকর্ট অফিসার আসামির দায়িত্ব বুঝে নেন ও সঙ্গে করে নিয়ে যান।
তদন্ত বিচারকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বাগতিক দেশের হাইকোর্ট বা সুপ্রিমকোর্টে আপিল করার সুযোগ থাকে। এছাড়া বিচারক কারাগারে পাঠানোর দুই মাসের মধ্যে যদি আসামিকে হস্তান্তর করা না হয়, তবে তিনি মুক্তির জন্য আবেদন করতে পারেন। অবশ্য যদি দেরি হওয়ার পেছনে কোনো যুক্তিসঙ্গত বা উপযুক্ত কারণ দেখানো যায়, তবে মুক্তির আবেদন নাকচও হতে পারে।
কারিগরি বা আইনি জটিলতার চেয়েও প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। শুধু ভারত নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতি অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন– এমন ব্যক্তির প্রত্যর্পণ নিরুৎসাহিত করা হয়।
অতীতে, ভারত মানবিক কারণ দেখিয়ে অনুরূপ পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি দেশের প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগ এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
প্রত্যর্পণের অনুরোধ কীভাবে পর্যালোচনা করা হবে, তা নির্ভর করবে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর। ভারত যদি অতিরিক্ত নথিপত্র বা কোনো নিশ্চয়তা চায়, তবে প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত হবে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে, বিশেষ করে বৈশ্বিক সংস্থাগুলো সুরক্ষা প্রদান বা স্বাধীন পর্যালোচনার আহ্বান জানায়।
এই প্রত্যর্পণের অনুরোধ আইন, বিচার, কূটনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতির বহুমুখী সন্ধিক্ষণ। বাংলাদেশের জন্য এই পুরো প্রক্রিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতারও পরীক্ষা। ভারতের জন্য, এটি আইনি বাধ্যবাধকতা, মানবিক নীতি, আন্তর্জাতিক চাপ ও কৌশলগত স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষার এক মুহূর্ত। ভারত শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিতে পারে, আইনি নজির পুনর্নির্ধারণ করতে পারে ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে প্রভাবিত করতে পারে।
লেখকদ্বয়: ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির জিন্দাল গ্লোবাল ল স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক
দ্য ডিপ্লোমেটের নিবন্ধ অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।

জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। গত ১৭ নভেম্বরের এই রায়ের বিপরীতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ অস্পষ্ট ও রহস্যজনক। এক সময়ের মিত্রের বিরুদ্ধে দেওয়া রায় ‘আমলে নিয়ে’ নয়াদিল্লি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা ‘সব অংশীজনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে যুক্ত’ থাকবে।
তিন সপ্তাহ পরে ঢাকার অনুরোধে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের অবস্থান ছিল আরও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি ফেরার বিষয়টি পুরোপুরি শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টার মূলে রয়েছে প্রায় এক যুগ আগে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি।
ঢাকা আনুষ্ঠানিকভাবে গত ২১ নভেম্বর শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছে। এ নিয়ে ভারত এখন কূটনৈতিক উভয় সংকটে পড়েছে। রায় ও প্রত্যর্পণ ইস্যু ভারত সরকারকে আইনি, নৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে।
ভারত সরকার ঢাকার অনুরোধ পর্যালোচনা করছে। ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার জোর দিয়ে বলছে, তাদের এই অনুরোধ দুদেশের মধ্যে ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের যুক্তি, এই চুক্তি অনুযায়ী গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত যেকোনো ব্যক্তিকে ফেরত দিতে ভারত বাধ্য, যদি তা পদ্ধতিগত মানদণ্ড পূরণ করে।
তবে ভারত সতর্কতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং এখনো কোনো ইঙ্গিত দেয়নি যে, তারা এই অনুরোধ গ্রহণ করবে, প্রত্যাখ্যান করবে, নাকি আরও ব্যাখ্যা চাইবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কোনো পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকে, তবে ভারত আইনগতভাবে প্রত্যর্পণ বিলম্বিত বা প্রত্যাখ্যান করার যৌক্তিকতা দেখাবে।
বাংলাদেশ যদি ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে চায়, সবার আগে তাঁকে সরকারিভাবে ‘পলাতক অপরাধী’ ঘোষণা করতে হবে। এরপর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, সেসব দুদেশের মধ্যে করা ‘প্রত্যর্পণ চুক্তিতে’ উল্লেখ আছে কিনা? উল্লেখ থাকলে তবেই ফেরত চাওয়া যাবে।
শেখ হাসিনার অপরাধের যাবতীয় প্রমাণ, আদালতের নথিসহ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘কনস্যুলার, পাসপোর্ট ও ভিসা (সিপিভি)’ বিভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জমা দিতে হবে। ভারতের ১৯৬২ সালের প্রত্যর্পণ আইন অনুযায়ী এসব যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া বেশ কঠোর। এখানে মামলার একটি শক্ত ‘প্রাথমিক ভিত্তি’ বা ‘প্রাইমা ফেসি’ প্রমাণ করা জরুরি। এর অর্থ হলো, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত প্রমাণ এতটাই জোরালো হতে হবে যে, একই ধরনের অপরাধ ভারতে সংঘটিত হলে, সেই প্রমাণের ভিত্তিতে সেখানে বিচারকাজ শুরু করা সম্ভব হয়।

তবে এই আইনের তৃতীয় অধ্যায়ে ‘দ্রুত’ বা সহজ প্রক্রিয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই নিয়মের অধীনে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অপরাধের শক্ত প্রাথমিক ভিত্তি বা ‘প্রাইমা ফেসি’ কেস দাঁড় করানোর বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে। পরিবর্তে, অনুরোধকারী দেশ (বাংলাদেশ) থেকে পাঠানো গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ নথিপত্র একজন প্রত্যর্পণ বিচারককে সন্তুষ্ট করলেই চলবে। বিচারককে নিশ্চিত হতে হবে, নথিপত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়েছে ও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ দুদেশের চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মধ্যে পড়ে।
ভারতের ১৯৬২ সালের আইনে আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণের আবেদন করার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাময়িক গ্রেপ্তার করার বিধান রয়েছে। তবে এই গ্রেপ্তারের অনুরোধ অবশ্যই কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিপিভি বিভাগে পাঠাতে হবে। এ কাজে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা বা ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়া সম্ভব। যদিও শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এমন কোনো সাময়িক গ্রেপ্তারের অনুরোধ জানানো হয়নি।
আইন অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক প্রত্যর্পণের আবেদন জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধকারী রাষ্ট্রকে ৪৫ থেকে ৬০ দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হয়। যদি এই সময়ের মধ্যে স্বাগতিক দেশের আদালত পলাতক আসামিকে মুক্তিও দেয়, তবুও তা ভবিষ্যতে তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার বা প্রত্যর্পণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। অর্থাৎ, পরে যদি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র এসে পৌঁছায়, তবে অভিযুক্তকে আবার গ্রেপ্তার করে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া চালানো যাবে।
একজন পলাতক অপরাধীকে হস্তান্তরের অনুরোধ কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে করা যেতে পারে; যেমন– দিল্লিতে অবস্থিত কোনো কূটনীতিকের মাধ্যমে, সরাসরি অনুরোধকারী সরকারের মাধ্যমে অথবা বিদেশের ভারতীয় মিশনের মাধ্যমে।
সিপিভি বিভাগ প্রত্যর্পণের অনুরোধ পাওয়ার পর যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যায়। যদি অনুরোধ উপযুক্ত মনে করা হয়, তবে মামলা তদন্তের জন্য একজন তদন্ত বিচারক নিয়োগ করা যেতে পারে। যখন পলাতকের পরিচয়, সমর্থনকারীর প্রমাণাদী, আইনের বিধান ও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হস্তান্তরের বিষয়ে তদন্ত বিচারকের প্রতিবেদন পরীক্ষা করা হয়, তখন প্রত্যর্পণ বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট ওই ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠাতে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। এই পর্যায়ে প্রত্যর্পণ বিচারক তাঁর প্রতিবেদন ও পলাতক অপরাধীর লিখিত বিবৃতি থাকলে তা কেন্দ্রীয় সরকারের বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দেন।
তদন্ত শেষ করার পর যদি প্রত্যর্পণ বিচারক দেখতে পান, বিদেশি রাষ্ট্রের অনুরোধ অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান মামলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে পলাতক অপরাধীকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। তদন্ত প্রতিবেদন ও পলাতক আসামির জবানবন্দি যাচাই-বাছাই করার পর সরকার তাঁকে ফেরত পাঠানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এজন্য সরকার আসামিকে হেফাজতে নেওয়া ও হস্তান্তরের জন্য পরোয়ানা জারি করতে পারে। এই পরোয়ানায় স্পষ্ট উল্লেখ থাকে, ঠিক কোন স্থানে ও কার কাছে আসামিকে তুলে দেওয়া হবে।
স্বাগতিক রাষ্ট্র চাইলে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। যদি তারা মনে করে, অপরাধের ধরন রাজনৈতিক বা সামরিক প্রকৃতির অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তি অনুরোধকারী দেশে বিচার বা শাস্তি থেকে দায়মুক্ত, তবে তাঁকে ফেরত পাঠাবে না। এছাড়া অভিযুক্ত যদি আগেই ওই অপরাধের জন্য বিচার বা শাস্তি পেয়ে থাকেন কিংবা খালাস বা ক্ষমা পেয়ে থাকেন, তাহলেও প্রত্যর্পণ করা হবে না। এমনকি যদি মনে হয় অভিযুক্তকে তাঁর বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, জাতীয়তা বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশে ফেরত চাওয়া হচ্ছে, তবে স্বাগতিক রাষ্ট্র এই অনুরোধ নাকচ করতে পারে।
অবশ্য অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি তদন্ত বিচারকের কাছে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়ে দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হতে বা শাস্তি মেনে নিতে রাজি হন, তাঁকে প্রত্যর্পণ করা সহজ। কিন্তু এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠানোর আগে বিচারককে ‘দ্বৈত অপরাধ’ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, যে অপরাধের জন্য ফেরত চাওয়া হচ্ছে, তা বাংলাদেশ ও ভারত– উভয় দেশের আইনের চোখে অপরাধ।
প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ার একদম শেষ ধাপে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তদন্ত বিচারকের সুপারিশ পাওয়ার পর সরকার যদি আসামিকে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়, তখন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিদেশি মিশন হস্তান্তরের প্রক্রিয়া ঠিক করবে। এরপর অনুরোধকারী দেশের একজন এসকর্ট অফিসার আসামির দায়িত্ব বুঝে নেন ও সঙ্গে করে নিয়ে যান।
তদন্ত বিচারকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বাগতিক দেশের হাইকোর্ট বা সুপ্রিমকোর্টে আপিল করার সুযোগ থাকে। এছাড়া বিচারক কারাগারে পাঠানোর দুই মাসের মধ্যে যদি আসামিকে হস্তান্তর করা না হয়, তবে তিনি মুক্তির জন্য আবেদন করতে পারেন। অবশ্য যদি দেরি হওয়ার পেছনে কোনো যুক্তিসঙ্গত বা উপযুক্ত কারণ দেখানো যায়, তবে মুক্তির আবেদন নাকচও হতে পারে।
কারিগরি বা আইনি জটিলতার চেয়েও প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। শুধু ভারত নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতি অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন– এমন ব্যক্তির প্রত্যর্পণ নিরুৎসাহিত করা হয়।
অতীতে, ভারত মানবিক কারণ দেখিয়ে অনুরূপ পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি দেশের প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগ এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
প্রত্যর্পণের অনুরোধ কীভাবে পর্যালোচনা করা হবে, তা নির্ভর করবে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর। ভারত যদি অতিরিক্ত নথিপত্র বা কোনো নিশ্চয়তা চায়, তবে প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত হবে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে, বিশেষ করে বৈশ্বিক সংস্থাগুলো সুরক্ষা প্রদান বা স্বাধীন পর্যালোচনার আহ্বান জানায়।
এই প্রত্যর্পণের অনুরোধ আইন, বিচার, কূটনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতির বহুমুখী সন্ধিক্ষণ। বাংলাদেশের জন্য এই পুরো প্রক্রিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সক্ষমতারও পরীক্ষা। ভারতের জন্য, এটি আইনি বাধ্যবাধকতা, মানবিক নীতি, আন্তর্জাতিক চাপ ও কৌশলগত স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষার এক মুহূর্ত। ভারত শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিতে পারে, আইনি নজির পুনর্নির্ধারণ করতে পারে ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে প্রভাবিত করতে পারে।
লেখকদ্বয়: ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির জিন্দাল গ্লোবাল ল স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক
দ্য ডিপ্লোমেটের নিবন্ধ অনুবাদ করেছেন তুফায়েল আহমদ।

লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতার বাড়িতে আগুন, তাঁর দুটি ছোট মেয়ের আগুনে পুড়ে মৃত্যু—এই ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন দুঃখ নয়; এগুলো হলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতার ধারাবাহিক ট্র্যাজেডি।
১ ঘণ্টা আগে
গণঅভ্যুত্থানের পর মাঠে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে, তার মধ্যে বিএনপির জনসমর্থন সবচেয়ে বেশি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারাই ক্ষমতায় যাবে বলে ধারণা সবচেয়ে জোরদার। অথচ দলটির সক্রিয় শীর্ষ নেতা এতদিন ছিলেন দেশে অনুপস্থিত।
৪ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরে প্রবীণতান্ত্রিকতার আধিপত্য লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতিকে এমন এক বৃত্তে বন্দী করেছিল, যেখানে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তরুণদের প্রবেশাধিকার ছিল খুব সীমিত।
১ দিন আগে
বিটিভি এদেশের মানুষের শৈশব, কৈশোর আর প্রৌঢ়ত্বের চিরসাথী। সাদা-কালো টেলিভিশন সেটের সামনে পুরো পাড়া মিলে বসে নাটক দেখার সেই নির্মল আনন্দ আজও আপ্লুত করে। ৬১ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় বিটিভি দেশের প্রতিটি বাঁকবদলের সাক্ষী।
২ দিন আগে