leadT1ad

তারেক রহমানের ‘জুম পলিটিক্স’ যেভাবে বাঁচিয়ে দিল বিএনপিকে

স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে গত দেড় দশক ছিল বিএনপি এবং তারেক রহমানের জন্য অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য যে অস্ত্রটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে, তা কোনো প্রচলিত রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়—তা হলো তথ্যপ্রযুক্তি। একসময় সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রী এবং মূলধারার গণমাধ্যমের একাংশ যেই তারেক রহমানকে ‘জুম নেতা’, ‘ল্যাপটপ বিপ্লব’ বলে উপহাস করত, সময়ের সঙ্গে সেই ডিজিটাল সংযোগই বিএনপির আপতকালে ‘লাইফলাইন’ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

১৭ বছরের দীর্ঘ নির্বাসনে থেকেও একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে সুসংহত রাখার নেপথ্যে এই ‘জুম পলিটিক্স’ বা ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন কীভাবে কাজ করেছে? তা আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হতে পারে।

২০০৮ সালে তারেক রহমান নিপীড়নের শিকার হয়ে লন্ডনে অবস্থান নেন। পরে দেশে তাঁর কণ্ঠস্বর প্রচারে আইনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সেই সময়ের সরকার ধরে নিয়েছিল যে এইবার বিএনপির চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়বে। কারণ প্রথাগত রাজনীতির ব্যাকরণ অনুযায়ী, নেতা চোখের আড়ালে থাকলে কর্মীরা পথ হারান। কিন্তু তারেক রহমান এই ‘ফিজিক্যাল গ্যাপ’ বা শারীরিক দূরত্ব ঘোচাতে বেছে নেন ‘ডিজিটাল ব্রিজ’।

শুরুতে স্কাইপ এবং পরবর্তীতে জুম, হোয়াটসঅ্যাপ ও সিগন্যালের মতো অ্যাপগুলো হয়ে ওঠে তাঁর ‘ভার্চুয়াল পার্টি অফিস’। ভৌত কার্যালয় পুলিশ দিয়ে তালাবদ্ধ করা সম্ভব, কিন্তু ক্লাউড বা ইন্টারনেটের কার্যালয় বন্ধ করা যায় না। বিটিআরসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি। এই বিশাল ডিজিটাল জনমিতিকে কাজে লাগিয়ে তারেক রহমান তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে পরিচালনার বাহন এনালগ থেকে ডিজিটালে রূপান্তর করেন।

নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে একটি বড় দল কীভাবে ভেঙে চুরমার হতে পারে, তার ধ্রুপদী উদাহরণ ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর শীর্ষ নেতৃত্বের অভাবে দলটি চরম বিশৃঙ্খলায় পড়ে। দলে একাধিক উপদল তৈরি হয়। যেমন মিজান গ্রুপ, রাজ্জাক গ্রুপ। তাদের নেতৃত্ব শৃঙ্খল সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরেও দল অনেকবার ভেঙেছে।

সেই হিসেবে বিএনপি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। তাদের নেতারা জীবিত ছিলেন। যদিও অন্যতম নেতা তারেক রহমান ছিলেন দেশের বাইরে নির্বাসিত। তবে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কার্যত গৃহবন্দি। টানা ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মুখে দলটির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার কথা ছিল। জাসদ, বাসদ বা ন্যাপের মতো দলগুলো নেতৃত্বের সংকটে ভেঙে টুকরো হয়েছে। কিন্তু সামান্য কিছু কোন্দল ছাড়া বিএনপি ছিলো অটুট।

এই ‘না ভাঙার’ অন্যতম কারণ কারণ তারেক রহমানের সার্বক্ষণিক ডিজিটাল মনিটরিং। সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে খালেদা জিয়ার আপোসহীন ইমেজ। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিএনপির কর্মীরা জুলুমের শিকার হয়ে এমন জায়গায় গিয়েছিলেন যে আপোষেরও কোন সুযোগ ছিল না। তবে এই সব কিছুকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজে লেগেছে তারেক রহমানের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ।

অনলাইন মিটিংয়ের মাধ্যমে তিনি দলের স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে তৃণমূলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও সরাসরি কথা বলেছেন। তারেক রহমান দলকে ‘নেতৃত্বহীনতার’ অনুভূতি কখনোই পেতে দেননি।

‘নেতা কে?’ মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ডিজিটাল জবাব

গত এক দশকে বাংলাদেশের টকশো এবং রাজনৈতিক আড্ডায় একটি গড়পড়তা বয়ান ছিল— ‘বিএনপির নেতা কে? বিদেশ থেকে কি দল চালানো যায়?’ এই প্রচারণা দলের অনেক কর্মীদের মনে সংশয় তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিল।

তারেক রহমান এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে বেছে নিয়েছেন নিজের ‘ভার্চুয়াল উপস্থিতি’। ভার্চুয়ালি তিনি কেবল ভাষণ দেননি, দল পরিচালনা করেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় তিনি লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। গুলশান অফিসে বড় পর্দায় তাঁর উপস্থিতি কর্মীদের আশ্বস্ত করেছিল— নেতা দূরে থাকলেও তিনি ‘লাইভ’ আছেন। এই প্রক্রিয়াটি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে, তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড তদারক করা হচ্ছে। ফলে মধ্যস্বত্বভোগী নেতাদের প্রভাব কমে আসে। শীর্ষ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

শুরুর দিকে তারেক রহমানের অনলাইন মিটিংগুলোর ভিডিও কোয়ালিটি বা কানেক্টিভিটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল বা মিম তৈরি হতে দেখা যেতো। বিরোধীরা বলতো, ‘ইন্টারনেটে কি আন্দোলন হয়?’ কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিশ্ব অচল হয়ে যাওয়ায় দেখা গেল কর্পোরেট থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা— সবই জুম বা ভিডিও কনফারেন্স নির্ভর হয়ে পড়েছে।

তারেক রহমান কোভিডের বহু আগেই এই মডেলে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। যেই টুলটি নিয়ে একসময় হাসাহাসি করা হতো, সেটিই হয়ে ওঠে বিএনপির টিকে যাওয়ার অন্যতম অবলম্বন। দেখা গেল, আধুনিক রাজনীতিতে ‘শারীরিক উপস্থিতি’র চেয়ে ‘কানেক্টিভিটি’ বা সংযোগ অনেক বেশি শক্তিশালী।

প্রযুক্তি যখন রাজনীতির গেম চেঞ্জার

তারেক রহমানের এই ‘জুম পলিটিক্স’ কৌশলগতভাবে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তারেক রহমান যদি সময়ের সাথে সঠিক প্রযুক্তির সাহায্য না নিয়ে সনাতন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করতেন, তাহলে বিএনপি হয়তো টিকে থাকতে আরও কষ্ট হত। তিনি ঠিক সময়েই নিজেকে এবং দলকে ডিজিটালি ট্রান্সফর্ম করেছেন।

আজ তিনি দেশে ফিরছেন। তাঁর হাতে রয়েছে একটি সুসংগঠিত ডিজিটাল আর্কাইভ। রয়েছে এমন একটি দল যা গত ১৭ বছরের টানা ঝড়েও নেতার নির্দেশনার বাইরে যায়নি। উপহাসের পাত্র থেকে অপরিহার্য নেতায় পরিণত হওয়ার এই যাত্রায় ‘জুম’ বা প্রযুক্তি ছিল তারেক রহমানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত হাতিয়ার।

Ad 300x250

সম্পর্কিত