ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব কমিয়ে জাতীয় স্বার্থ, সীমান্ত নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যকে সামনে আনা হয়েছে। রাশিয়ার অস্বাভাবিক সমর্থন, ইউরোপের উদ্বেগ, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনিশ্চয়তা এবং পশ্চিম গোলার্ধে সম্ভাব্য উত্তেজনা, সব মিলিয়ে এই কৌশল বিশ্বরাজনীতির কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে সুযোগ যেমন আছে, তেমনি গভীর ঝুঁকিও রয়েছে।
মাহবুবুল আলম তারেক

চলতি মাসের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ৩৩ পৃষ্ঠার নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএস) প্রকাশ করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকা সবার আগে’ ধারণাকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। স্নায়ু যুদ্ধের পর যে কৌশলগুলো প্রাধান্য পাচ্ছিল, এটি তার থেকে একেবারে ভিন্ন পথে হাঁটছে। আগের কৌশলগুলোকে এখানে সমালোচনা করে বলা হয়েছে, সেগুলো ছিল অস্পষ্ট, অতি হস্তক্ষেপমূলক, যা বিশ্বায়নের নামে মার্কিন অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করেছে।
নতুন এই নথিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মতো সারা পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেওয়া বা সব বোঝা কাঁধে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করবে না। বরং বাস্তব হিসাব-নিকাশ, সীমিত হস্তক্ষেপ এবং স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে নীতি নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে মার্কিন আধিপত্যের বদলে পৃথিবী ও বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা, এটাই প্রধান লক্ষ্য।
দেশের ভেতরের শক্তিকে এই কৌশলে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন, অর্থনীতি মজবুত রাখা, সীমান্ত আরও কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, সামরিক বাহিনীকে আরও সক্ষম ও আধুনিক করা। পাশাপাশি মিত্র দেশগুলোর ওপর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বোঝা ভাগ করে নেওয়ার চাপ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া চলমান যুদ্ধ-সংঘাতগুলোতে সরাসরি না জড়িয়ে কূটনীতির মাধ্যমে সমাধানের কথা বলা হচ্ছে।
রাশিয়ার অস্বাভাবিক সমর্থন
কৌশলটি প্রকাশের পর সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রতিক্রিয়া এসেছে রাশিয়া থেকে। মস্কো বলেছে, এই কৌশল নাকি ‘রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়’। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলকে রাশিয়া এত খোলামেলা প্রশংসা আগে কখনো করেনি।
এর কারণও স্পষ্ট। নথিতে রাশিয়াকে আর প্রধান শত্রু বা বড় হুমকি হিসেবে চিত্রিত করা হয়নি। বরং ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান, রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত স্থিতিশীলতা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর নীতির সমালোচনায় বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য আলোচনার কথা বলা হয়েছে এবং রাশিয়াকে ‘নিয়ন্ত্রণযোগ্য’ বা সহজে সামাল দেওয়া যায় এমন হুমকি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিপরীতে, ইউরোপকে অভিযুক্ত করা হয়েছে যে তারা যুদ্ধ নিয়ে অতিরিক্ত ও অবাস্তব প্রত্যাশা তৈরি করছে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের বিশ্লেষক ও সাবেক মার্কিন দূত স্টিভেন পাইফার মনে করেন, রাশিয়ার খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ২০১৭ সালের কৌশলে রাশিয়াকে যে, যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য খর্ব করার জন্য নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনকারী হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, নতুন নথিতে স্পষ্টভাবে সেই অবস্থান থেকে সরে আসা হয়েছে। তার বদলে রাশিয়ার সঙ্গে আবার কৌশলগত স্থিতিশীলতা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে এবং অভিবাসন ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য হারানোর মতো বিষয়ে ইউরোপকে বেশি দায়ী করা হয়েছে।
ট্রাম্পের নতুন কৌশলের মূল দিকগুলো
নতুন কৌশলে মার্কিন জাতীয় স্বার্থের পরিসর ছোট করে আনা হয়েছে। প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো—যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীন ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখা। অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন, সন্ত্রাসবাদ ও গুপ্তচরবৃত্তির মতো হুমকি থেকে সুরক্ষা। আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা নিশ্চিত করা (এর মধ্যে প্রস্তাবিত ‘গোল্ডেন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্পও আছে)। নতুন করে শিল্প-কারখানা তৈরি ও জ্বালানি নিরাপত্তার মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল করা। দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
মূল নীতিগুলোর মধ্যে আছে—‘আমেরিকা ফার্স্ট’, জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, শক্তির ভারসাম্য ধরে রাখা এবং শ্রমিকবান্ধব নীতি। নথিতে সরাসরি বলা হয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য কেবলই দেশের মূল জাতীয় স্বার্থ রক্ষা। এর বাইরে কোনো বৃহৎ আদর্শের কথা সেখানে নেই।
এই কৌশলে ১৯ শতকের বিখ্যাত ‘মনরো নীতি’ আবার সামনে আনা হয়েছে। তখন যেমন পশ্চিম গোলার্ধ—অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয় বলে দাবি করা হয়েছিল, এখন সেই ধারণাকেই নতুন মোড়কে হাজির করা হয়েছে। মূল কথা, এই অঞ্চলে বাইরের শক্তির রাজনৈতিক প্রভাব যতটা সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা এবং যুক্তরাষ্ট্রকেই কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কৌশলের মূল দিকগুলো হলো:
বড় আকারের অভিবাসন বন্ধ
অতিরিক্ত অভিবাসনকে এই কৌশলে সবচেয়ে বড় ভিনদেশি হুমকি বলা হয়েছে। সীমান্ত নিরাপত্তাকে সরাসরি জাতীয় প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। যুক্তি হলো, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও মানবপাচার, বিদেশি প্রভাব—এই সবকিছুই দুর্বল সীমান্তের সুযোগ নেয়।
মিত্রদের ওপর বেশি দায়িত্ব
‘হেগ কমিটমেন্ট’ নামের একটি ধারণা সামনে এনে ন্যাটো সদস্যদের বলা হয়েছে, নিজেদের জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করতে হবে। অর্থাৎ ইউরোপসহ মিত্র দেশগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নিজেদেরকেই বেশি খরচ করতে হবে, সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে থাকা যাবে না।
কূটনীতির মাধ্যমে শান্তি
ইউক্রেনসহ বিভিন্ন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলা হয়েছে। তবে সেই কূটনীতি শুধু প্রচলিত ধারায় হবে না। সঙ্গে থাকবে সামরিক শক্তি প্রদর্শন আর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
বাণিজ্যে পারস্পরিকতা, জরুরি পণ্যের সাপ্লাই চেইন নিরাপদ করা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মতো খাতে নেতৃত্ব ধরে রাখাকে ভবিষ্যতের মূল লড়াই হিসেবে দেখা হয়েছে।
কোন অঞ্চলে কেমন নীতি
পশ্চিম গোলার্ধ
মনরো নীতির ট্রাম্পীয় সংস্করণে এই অঞ্চলকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য তিনটি—যুক্তরাষ্ট্রমুখী অভিবাসন কমানো। চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ঠেকানো। মাদকচক্রের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া।
কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, পশ্চিম গোলার্ধকে এতটা স্থিতিশীল ও সুশাসিত রাখতে হবে যেন সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ব্যাপক অভিবাসনের চাপ না তৈরি হয়।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল
এই অঞ্চলকে ভবিষ্যতের বড় অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সংঘাতের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চীনের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্যকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে। এর জবাবে কোয়াডের মতো আঞ্চলিক জোট, সামরিক জোট এবং অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে চীনকে প্রতিহত করার কথা বলা হয়েছে।
তাইওয়ানের প্রশ্নে সরাসরি নীতি পরিবর্তন না করলেও, তাইওয়ানকে ঘিরে সম্ভাব্য সংঘাত ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আরও সামরিক প্রস্তুতি বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে চীনকে সামরিক নয়, মূলত অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে।
ইউরোপ
নতুন কৌশলে ইউরোপকে নিয়ে বার্তা জটিল। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান এবং রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির মাধ্যমে কৌশলগত স্থিতিশীলতার কথা বলা হয়েছে, অন্যদিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসননীতি এবং বিদেশিদের সংখ্যা বাড়ার ফলে পশ্চিমা সংস্কৃতির অবক্ষয়ের মতো ইস্যুতে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে। ‘ইউরোপের মহত্ত্ব’ ফেরানোর নামে কট্টর ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রতি সহানুভূতির বার্তাও এতে ইঙ্গিত আকারে আছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের মতো বার্তা দিচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য
এলাকাটিকে আর ‘অন্তহীন যুদ্ধের’ কেন্দ্র হিসেবে দেখতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার সরাসরি সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আব্রাহাম অ্যাকর্ডস-এর মতো সমঝোতাকে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর নতুন সমীকরণ গড়ার কথা বলা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম চলবে, তবে বড় আকারে নতুন যুদ্ধ শুরু করার ইঙ্গিত নেই।
আফ্রিকা
এখানে সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে, নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে সমালোচকদের মতে, শুধু সম্পদ আহরণের দিকে তাকিয়ে থাকলে আফ্রিকায় প্রকৃত উন্নয়ন ও গণতন্ত্র শক্তি শক্তিশালী হবে না।
সম্ভাব্য বৈশ্বিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই কৌশল বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক জোটের কাঠামো ও শক্তির ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিচ্ছে, তখন চীন ও রাশিয়া নিজেদের প্রভাববলয় বড়াতে আরও উৎসাহিত হতে পারে।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর)-এর রেবেকা লিসনার বলছেন, আগের কৌশলগুলোতে ‘বড় শক্তির প্রতিযোগিতা’ ছিল কেন্দ্রীয় বিষয়; নতুন নথিতে সেই জায়গা এখন মূলত অর্থনীতি দখল করেছে। অর্থাৎ, সামরিক লড়াইয়ের চেয়ে বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও বাজার নিয়ন্ত্রণই হয়ে উঠছে মূল যুদ্ধক্ষেত্র।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমালোচনা এবং কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রতি পরোক্ষ সমর্থন—দুটোই ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্কে নতুন টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে। ইউরোপীয় নেতাদের অনেকে মনে করছেন, অভিবাসন নিয়ে নতুন কৌশলপত্রের ভাষা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের মতো। কেউ কেউ এটিকে ‘স্বৈরশাসকের ভাষা’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
চীনকে সরাসরি শত্রু না বলে ‘অর্থনৈতিক প্রতিযোগী’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এতে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে চীনের সঙ্গে ‘পারস্পরিক লাভজনক’ সম্পর্কের কথা বলছে, অন্যদিকে আবার পশ্চিম গোলার্ধকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মিত্রদের কাছে একধরনের দ্বৈত সংকেত যাচ্ছে।
মনরো নীতির নতুন ব্যাখ্যার ফলে লাতিন আমেরিকায় পুরোনো ক্ষোভ আবার জেগে ওঠার আশঙ্কা আছে। মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সামরিক হামলা, চীনের অবকাঠামো প্রকল্প ঠেকানো—এসব পদক্ষেপ স্থানীয় জনগণের চোখে যুক্তরাষ্ট্রকে আবার ভিনদেশে ‘হস্তক্ষেপকারী শক্তি’ হিসেবে হাজির করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি এখান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসে, তাহলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে অন্যরা তা পূরণে এগিয়ে আসবে। যেমন, চীন ও রাশিয়া। এতে শক্তির নতুন সমীকরণ তৈরি হবে। আফ্রিকা নিয়ে কৌশলে যতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাষা আছে, বাস্তবে তা অর্জন সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
বিশেষজ্ঞদের সার্বিক মূল্যায়ন
ব্রুকিংস ও সিএফআরের অনেক গবেষক মনে করেন, নতুন কৌশলে অনেক অসঙ্গতি ও ঝুঁকি আছে। কেউ কেউ বলছেন, একদিকে ট্রাম্পকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, অন্যদিকে মাদকচক্রের ওপর সামরিক হামলার মতো আগ্রাসী নীতির কথাও আছে। এগুলো পরস্পরবিরোধী বার্তা দেয়।
আরও একটি সমালোচনা হলো, এই কৌশল মিত্রদের বোঝা হিসেবে দেখায়, কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র আগের মতোই বৈশ্বিক প্রভাব ধরে রাখতে চায়। সংযমের কথা বলা হলেও নীতির ভেতরে আবার ‘প্রাধান্য ধরে রাখার’ প্রবণতা রয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার কথা বলা হলেও অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করলে মিত্রদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, ডলারের প্রভাবও দুর্বল হতে পারে—এমন আশঙ্কাও রয়েছে।
অবশ্য সবাই যে একমুখী সমালোচনা করছেন, তা নয়। কেউ কেউ বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত ভূমিকা, মিত্রদের ওপর বেশি দায়িত্ব দেওয়া বা শান্তি প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মতো অংশগুলো ইতিবাচকও হতে পারে, যদি তা বাস্তবে সুষমভাবে কার্যকর হয়।
সব মিলিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে অনেক বেশি স্বদেশমুখী, জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক ও আঞ্চলিক ভারসাম্য-নির্ভর করে তুলতে চাইছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে আর ‘বিশ্বব্যবস্থা কাঁধে তোলা’ একক শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছে না, বরং শক্তিশালী কিন্তু সীমিত ভূমিকায় থাকা এক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরছে।
কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যবস্থার পুরোনো কাঠামো নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। মিত্রদের মধ্যে সন্দেহ, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে নতুন সুযোগ এবং বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তির শূন্যতা, সব মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরে বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্য আরও অনিশ্চিত ও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত, এই কৌশল সফল না ব্যর্থ হবে, তা নির্ভর করবে, যুক্তরাষ্ট্র কতটা দক্ষভাবে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এবং একই সঙ্গে কতটা দায়িত্বশীলভাবে বৈশ্বিক স্থিতি বজায় রাখতে সক্ষম হয় তার ওপর।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, ব্রকিংস ডট এডু, নিউজ উইক, সিএফআর ডট ওআরজি

চলতি মাসের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ৩৩ পৃষ্ঠার নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএস) প্রকাশ করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকা সবার আগে’ ধারণাকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। স্নায়ু যুদ্ধের পর যে কৌশলগুলো প্রাধান্য পাচ্ছিল, এটি তার থেকে একেবারে ভিন্ন পথে হাঁটছে। আগের কৌশলগুলোকে এখানে সমালোচনা করে বলা হয়েছে, সেগুলো ছিল অস্পষ্ট, অতি হস্তক্ষেপমূলক, যা বিশ্বায়নের নামে মার্কিন অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করেছে।
নতুন এই নথিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মতো সারা পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেওয়া বা সব বোঝা কাঁধে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করবে না। বরং বাস্তব হিসাব-নিকাশ, সীমিত হস্তক্ষেপ এবং স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে নীতি নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে মার্কিন আধিপত্যের বদলে পৃথিবী ও বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা, এটাই প্রধান লক্ষ্য।
দেশের ভেতরের শক্তিকে এই কৌশলে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন, অর্থনীতি মজবুত রাখা, সীমান্ত আরও কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, সামরিক বাহিনীকে আরও সক্ষম ও আধুনিক করা। পাশাপাশি মিত্র দেশগুলোর ওপর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের বোঝা ভাগ করে নেওয়ার চাপ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া চলমান যুদ্ধ-সংঘাতগুলোতে সরাসরি না জড়িয়ে কূটনীতির মাধ্যমে সমাধানের কথা বলা হচ্ছে।
রাশিয়ার অস্বাভাবিক সমর্থন
কৌশলটি প্রকাশের পর সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রতিক্রিয়া এসেছে রাশিয়া থেকে। মস্কো বলেছে, এই কৌশল নাকি ‘রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়’। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলকে রাশিয়া এত খোলামেলা প্রশংসা আগে কখনো করেনি।
এর কারণও স্পষ্ট। নথিতে রাশিয়াকে আর প্রধান শত্রু বা বড় হুমকি হিসেবে চিত্রিত করা হয়নি। বরং ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান, রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত স্থিতিশীলতা এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর নীতির সমালোচনায় বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য আলোচনার কথা বলা হয়েছে এবং রাশিয়াকে ‘নিয়ন্ত্রণযোগ্য’ বা সহজে সামাল দেওয়া যায় এমন হুমকি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিপরীতে, ইউরোপকে অভিযুক্ত করা হয়েছে যে তারা যুদ্ধ নিয়ে অতিরিক্ত ও অবাস্তব প্রত্যাশা তৈরি করছে।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের বিশ্লেষক ও সাবেক মার্কিন দূত স্টিভেন পাইফার মনে করেন, রাশিয়ার খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ২০১৭ সালের কৌশলে রাশিয়াকে যে, যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য খর্ব করার জন্য নতুন বিশ্বব্যবস্থা গঠনকারী হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, নতুন নথিতে স্পষ্টভাবে সেই অবস্থান থেকে সরে আসা হয়েছে। তার বদলে রাশিয়ার সঙ্গে আবার কৌশলগত স্থিতিশীলতা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে এবং অভিবাসন ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য হারানোর মতো বিষয়ে ইউরোপকে বেশি দায়ী করা হয়েছে।
ট্রাম্পের নতুন কৌশলের মূল দিকগুলো
নতুন কৌশলে মার্কিন জাতীয় স্বার্থের পরিসর ছোট করে আনা হয়েছে। প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো—যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীন ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখা। অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন, সন্ত্রাসবাদ ও গুপ্তচরবৃত্তির মতো হুমকি থেকে সুরক্ষা। আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা নিশ্চিত করা (এর মধ্যে প্রস্তাবিত ‘গোল্ডেন ডোম’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা প্রকল্পও আছে)। নতুন করে শিল্প-কারখানা তৈরি ও জ্বালানি নিরাপত্তার মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল করা। দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
মূল নীতিগুলোর মধ্যে আছে—‘আমেরিকা ফার্স্ট’, জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, শক্তির ভারসাম্য ধরে রাখা এবং শ্রমিকবান্ধব নীতি। নথিতে সরাসরি বলা হয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য কেবলই দেশের মূল জাতীয় স্বার্থ রক্ষা। এর বাইরে কোনো বৃহৎ আদর্শের কথা সেখানে নেই।
এই কৌশলে ১৯ শতকের বিখ্যাত ‘মনরো নীতি’ আবার সামনে আনা হয়েছে। তখন যেমন পশ্চিম গোলার্ধ—অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয় বলে দাবি করা হয়েছিল, এখন সেই ধারণাকেই নতুন মোড়কে হাজির করা হয়েছে। মূল কথা, এই অঞ্চলে বাইরের শক্তির রাজনৈতিক প্রভাব যতটা সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা এবং যুক্তরাষ্ট্রকেই কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। কৌশলের মূল দিকগুলো হলো:
বড় আকারের অভিবাসন বন্ধ
অতিরিক্ত অভিবাসনকে এই কৌশলে সবচেয়ে বড় ভিনদেশি হুমকি বলা হয়েছে। সীমান্ত নিরাপত্তাকে সরাসরি জাতীয় প্রতিরক্ষার অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। যুক্তি হলো, সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও মানবপাচার, বিদেশি প্রভাব—এই সবকিছুই দুর্বল সীমান্তের সুযোগ নেয়।
মিত্রদের ওপর বেশি দায়িত্ব
‘হেগ কমিটমেন্ট’ নামের একটি ধারণা সামনে এনে ন্যাটো সদস্যদের বলা হয়েছে, নিজেদের জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষায় খরচ করতে হবে। অর্থাৎ ইউরোপসহ মিত্র দেশগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য নিজেদেরকেই বেশি খরচ করতে হবে, সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে থাকা যাবে না।
কূটনীতির মাধ্যমে শান্তি
ইউক্রেনসহ বিভিন্ন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলা হয়েছে। তবে সেই কূটনীতি শুধু প্রচলিত ধারায় হবে না। সঙ্গে থাকবে সামরিক শক্তি প্রদর্শন আর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা
বাণিজ্যে পারস্পরিকতা, জরুরি পণ্যের সাপ্লাই চেইন নিরাপদ করা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মতো খাতে নেতৃত্ব ধরে রাখাকে ভবিষ্যতের মূল লড়াই হিসেবে দেখা হয়েছে।
কোন অঞ্চলে কেমন নীতি
পশ্চিম গোলার্ধ
মনরো নীতির ট্রাম্পীয় সংস্করণে এই অঞ্চলকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য তিনটি—যুক্তরাষ্ট্রমুখী অভিবাসন কমানো। চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ঠেকানো। মাদকচক্রের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া।
কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, পশ্চিম গোলার্ধকে এতটা স্থিতিশীল ও সুশাসিত রাখতে হবে যেন সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ব্যাপক অভিবাসনের চাপ না তৈরি হয়।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল
এই অঞ্চলকে ভবিষ্যতের বড় অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সংঘাতের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চীনের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্যকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করা হচ্ছে। এর জবাবে কোয়াডের মতো আঞ্চলিক জোট, সামরিক জোট এবং অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে চীনকে প্রতিহত করার কথা বলা হয়েছে।
তাইওয়ানের প্রশ্নে সরাসরি নীতি পরিবর্তন না করলেও, তাইওয়ানকে ঘিরে সম্ভাব্য সংঘাত ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আরও সামরিক প্রস্তুতি বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে চীনকে সামরিক নয়, মূলত অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে।
ইউরোপ
নতুন কৌশলে ইউরোপকে নিয়ে বার্তা জটিল। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান এবং রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির মাধ্যমে কৌশলগত স্থিতিশীলতার কথা বলা হয়েছে, অন্যদিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসননীতি এবং বিদেশিদের সংখ্যা বাড়ার ফলে পশ্চিমা সংস্কৃতির অবক্ষয়ের মতো ইস্যুতে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে। ‘ইউরোপের মহত্ত্ব’ ফেরানোর নামে কট্টর ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রতি সহানুভূতির বার্তাও এতে ইঙ্গিত আকারে আছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের মতো বার্তা দিচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য
এলাকাটিকে আর ‘অন্তহীন যুদ্ধের’ কেন্দ্র হিসেবে দেখতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার সরাসরি সামরিক উপস্থিতি কমিয়ে আব্রাহাম অ্যাকর্ডস-এর মতো সমঝোতাকে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর নতুন সমীকরণ গড়ার কথা বলা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম চলবে, তবে বড় আকারে নতুন যুদ্ধ শুরু করার ইঙ্গিত নেই।
আফ্রিকা
এখানে সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে, নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে সমালোচকদের মতে, শুধু সম্পদ আহরণের দিকে তাকিয়ে থাকলে আফ্রিকায় প্রকৃত উন্নয়ন ও গণতন্ত্র শক্তি শক্তিশালী হবে না।
সম্ভাব্য বৈশ্বিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই কৌশল বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক জোটের কাঠামো ও শক্তির ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যখন নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিচ্ছে, তখন চীন ও রাশিয়া নিজেদের প্রভাববলয় বড়াতে আরও উৎসাহিত হতে পারে।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর)-এর রেবেকা লিসনার বলছেন, আগের কৌশলগুলোতে ‘বড় শক্তির প্রতিযোগিতা’ ছিল কেন্দ্রীয় বিষয়; নতুন নথিতে সেই জায়গা এখন মূলত অর্থনীতি দখল করেছে। অর্থাৎ, সামরিক লড়াইয়ের চেয়ে বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও বাজার নিয়ন্ত্রণই হয়ে উঠছে মূল যুদ্ধক্ষেত্র।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমালোচনা এবং কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলোর প্রতি পরোক্ষ সমর্থন—দুটোই ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্কে নতুন টানাপোড়েন তৈরি করতে পারে। ইউরোপীয় নেতাদের অনেকে মনে করছেন, অভিবাসন নিয়ে নতুন কৌশলপত্রের ভাষা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের মতো। কেউ কেউ এটিকে ‘স্বৈরশাসকের ভাষা’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
চীনকে সরাসরি শত্রু না বলে ‘অর্থনৈতিক প্রতিযোগী’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এতে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে চীনের সঙ্গে ‘পারস্পরিক লাভজনক’ সম্পর্কের কথা বলছে, অন্যদিকে আবার পশ্চিম গোলার্ধকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মিত্রদের কাছে একধরনের দ্বৈত সংকেত যাচ্ছে।
মনরো নীতির নতুন ব্যাখ্যার ফলে লাতিন আমেরিকায় পুরোনো ক্ষোভ আবার জেগে ওঠার আশঙ্কা আছে। মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সামরিক হামলা, চীনের অবকাঠামো প্রকল্প ঠেকানো—এসব পদক্ষেপ স্থানীয় জনগণের চোখে যুক্তরাষ্ট্রকে আবার ভিনদেশে ‘হস্তক্ষেপকারী শক্তি’ হিসেবে হাজির করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি এখান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসে, তাহলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে অন্যরা তা পূরণে এগিয়ে আসবে। যেমন, চীন ও রাশিয়া। এতে শক্তির নতুন সমীকরণ তৈরি হবে। আফ্রিকা নিয়ে কৌশলে যতটা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাষা আছে, বাস্তবে তা অর্জন সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
বিশেষজ্ঞদের সার্বিক মূল্যায়ন
ব্রুকিংস ও সিএফআরের অনেক গবেষক মনে করেন, নতুন কৌশলে অনেক অসঙ্গতি ও ঝুঁকি আছে। কেউ কেউ বলছেন, একদিকে ট্রাম্পকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, অন্যদিকে মাদকচক্রের ওপর সামরিক হামলার মতো আগ্রাসী নীতির কথাও আছে। এগুলো পরস্পরবিরোধী বার্তা দেয়।
আরও একটি সমালোচনা হলো, এই কৌশল মিত্রদের বোঝা হিসেবে দেখায়, কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র আগের মতোই বৈশ্বিক প্রভাব ধরে রাখতে চায়। সংযমের কথা বলা হলেও নীতির ভেতরে আবার ‘প্রাধান্য ধরে রাখার’ প্রবণতা রয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার কথা বলা হলেও অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করলে মিত্রদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক খারাপ হতে পারে, ডলারের প্রভাবও দুর্বল হতে পারে—এমন আশঙ্কাও রয়েছে।
অবশ্য সবাই যে একমুখী সমালোচনা করছেন, তা নয়। কেউ কেউ বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সীমিত ভূমিকা, মিত্রদের ওপর বেশি দায়িত্ব দেওয়া বা শান্তি প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মতো অংশগুলো ইতিবাচকও হতে পারে, যদি তা বাস্তবে সুষমভাবে কার্যকর হয়।
সব মিলিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে অনেক বেশি স্বদেশমুখী, জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক ও আঞ্চলিক ভারসাম্য-নির্ভর করে তুলতে চাইছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে আর ‘বিশ্বব্যবস্থা কাঁধে তোলা’ একক শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছে না, বরং শক্তিশালী কিন্তু সীমিত ভূমিকায় থাকা এক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরছে।
কিন্তু এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যবস্থার পুরোনো কাঠামো নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। মিত্রদের মধ্যে সন্দেহ, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে নতুন সুযোগ এবং বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তির শূন্যতা, সব মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরে বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্য আরও অনিশ্চিত ও অস্থির হয়ে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত, এই কৌশল সফল না ব্যর্থ হবে, তা নির্ভর করবে, যুক্তরাষ্ট্র কতটা দক্ষভাবে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে এবং একই সঙ্গে কতটা দায়িত্বশীলভাবে বৈশ্বিক স্থিতি বজায় রাখতে সক্ষম হয় তার ওপর।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, রয়টার্স, দ্য গার্ডিয়ান, ব্রকিংস ডট এডু, নিউজ উইক, সিএফআর ডট ওআরজি

ইসরায়েল গাজাকে নিরাপত্তা সমস্যা হিসেবে দেখছে, আর ফিলিস্তিনিরা একে দেখছে অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গির মেরুকরণ যতদিন না কমবে, ততদিন যেকোনো যুদ্ধবিরতিই হবে ক্ষণস্থায়ী।
১ দিন আগে
ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু বিনোদন নয়—মত প্রকাশ, পরিচয় নির্মাণ ও বিশ্বসংযোগেরও প্রধান মাধ্যম। এমন এক সময়ে অস্ট্রেলিয়া ১৬ বছরের নিচের ব্যবহারকারীদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার ঐতিহাসিক আইন পাস করেছে।
১ দিন আগে
অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে। এটি বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অধ্যাদেশের ফলে সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় গঠিত হয়। এতে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা সরাসরি প্রধান বিচারপতির অধীনে আসে।
২ দিন আগে
ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছেন কিনা, কোনো কারচুপি হচ্ছে কিনা কিংবা নির্বাচনী কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা—এসব বিষয় তদারকি করে প্রতিবেদন দেওয়াই তাদের কাজ।
৩ দিন আগে