leadT1ad

স্ট্রিম এক্সপ্লেইনার/জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ নিয়ে বিতর্ক কেন

অধ্যাদেশের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো ধারা ৭-এর সংশোধন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের জন্য একটি বাছাই কমিটি বা সিলেকশন কমিটি থাকে। প্রথমে ৯ নভেম্বরের প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে এই কমিটিতে কোনো আমলাতান্ত্রিক প্রতিনিধি রাখা হয়নি, যা কমিশনের স্বাধীনতার পথে ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু ৮ ডিসেম্বরের সংশোধিত অধ্যাদেশে এই কমিটিতে ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ’-কে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে সরকার ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ বাছাই কমিটিতে প্রতিষ্ঠিত হলো।

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

অধ্যাদেশে এমন কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে, যাকে ‘আমলাতন্ত্রের জবরদখল’ বলা হচ্ছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দাবি দীর্ঘদিনের। গত বছর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে মানবাধিকার কমিশন ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগে গত ৯ নভেম্বর সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করে। এর ধারাবাহিকতায় এক মাসের ব্যবধানে গত ৮ ডিসেম্বর সরকার ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ গেজেট প্রকাশ করে।

এই সংশোধিত অধ্যাদেশে এমন কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে, যাকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ও মানবাধিকারকর্মীরা কমিশনের ওপর ‘আমলাতন্ত্রের জবরদখল’ হিসেবে অভিহিত করছেন। মানবাধিকার কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বদলে এটিকে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার এক গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

অধ্যাদেশে কী আছে

নতুন এই অধ্যাদেশ ২০০৯ সালের মূল আইনের কিছু ধারায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। অধ্যাদেশ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর মাধ্যমে কমিশনের কাঠামো, ক্ষমতা, কার্যাবলি ও কর্মপরিধিতে বেশ কিছু নতুন সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে।

অধ্যাদেশের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো ধারা ৭-এর সংশোধন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগের জন্য একটি বাছাই কমিটি বা সিলেকশন কমিটি থাকে। প্রথমে ৯ নভেম্বরের প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে এই কমিটিতে কোনো আমলাতান্ত্রিক প্রতিনিধি রাখা হয়নি, যা কমিশনের স্বাধীনতার পথে ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল।

কিন্তু ৮ ডিসেম্বরের সংশোধিত অধ্যাদেশে এই কমিটিতে ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ’-কে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে সরকার ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ বাছাই কমিটিতে প্রতিষ্ঠিত হলো।

অধ্যাদেশের উল্লেখযোগ্য ও ইতিবাচক দিক হলো ধারা ৩০ক সংযোজন। এর মাধ্যমে কমিশনে ‘জাতীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিভাগ’ বা ‘ন্যাশনাল প্রিভেন্টিভ মেকানিজম (এনপিএম)’ নামে নতুন উইং খোলার বিধান রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের (ইউএনসিএটি) ঐচ্ছিক প্রোটোকল অনুযায়ী এটি গঠন করা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা। নতুন আইনে এই বিভাগকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

এই বিভাগ কারাগার, হাজতখানা, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র, থানা, অভিবাসী আটক কেন্দ্র, মানসিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, সামরিক আটক কেন্দ্র, বন্দি বা আটক ব্যক্তিদের পরিবহন যান, সেফ হোম ও পরিচর্যা কেন্দ্রসহ যে সকল স্থানে মানুষের স্বাধীনতা হরণ করা হয়, সেই সকল স্থান চিহ্নিত করবে ও নিয়মিত বা আকস্মিক পরিদর্শন করবে।

এনপিএম বিভাগের সদস্যরা আটক বা বন্দি ব্যক্তিদের সংখ্যা, পরিচয়, অবস্থান এবং তাদের প্রতি আচরণ সংক্রান্ত যেকোনো নথি বা রেজিস্ট্রার পরীক্ষা করতে পারবেন। তারা বন্দি, তাদের স্বজন এবং আটক কেন্দ্রের কর্মীদের সঙ্গে একান্তে বা গোপনে সাক্ষাৎকার নিতে পারবেন, যেখানে কর্তৃপক্ষের কেউ উপস্থিত থাকতে পারবে না। নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক আচরণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে তারা সরকারকে সুপারিশ করবেন এবং সেই সুপারিশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।

অধ্যাদেশের ১৬ নম্বর ধারায় ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ শব্দগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। মূল আইনে বলা ছিল, মানবাধিকার কমিশন যখন কোনো তদন্ত করে সরকারকে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোনো সুপারিশ করে, তখন সেই সুপারিশ অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো, তা কমিশনকে জানানো সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল।

সেখানে বলা ছিল ‘অবহিত করিতে হইবে’। কিন্তু সংশোধিত অধ্যাদেশে এই শব্দগুচ্ছ পরিবর্তন করে ‘অবহিত করা যাইবে’ করা হয়েছে। আইনি পরিভাষায় ‘যাইবে’ শব্দটি ব্যবহারের ফলে সরকারের জন্য কমিশনের সুপারিশ মানা বা সে বিষয়ে জবাবদিহি করা আর বাধ্যতামূলক রইল না; এটি এখন ঐচ্ছিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধারা ৩৫ সংশোধন করে কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে কিছু নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সরকার প্রতি বছর নির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করবে, যা কমিশন তার প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যয় করতে পারবে। তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, এই ব্যয় সরকারি বিধি-বিধান মেনেই করতে হবে। এর মাধ্যমে কমিশনের আর্থিক স্বায়ত্তশাসন কিছুটা নিশ্চিত করা হলেও, সরকারি বিধির বেড়াজাল রয়েই গেছে।

কেন বলা হচ্ছে আমলাতন্ত্রের দখলদারত্ব?

‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারির পর থেকেই মানবাধিকার সংগঠন ও সিভিল সোসাইটির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে এই অধ্যাদেশকে ‘আমলাতন্ত্রের করায়ত্ত’ করার ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছে।

টিআইবি বলছে, একটি স্বাধীন কমিশনের পূর্বশর্ত হলো এর নিয়োগ প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও সরকারের প্রত্যক্ষ প্রভাবমুক্ত। মানবাধিকার কমিশনের কাজই হলো রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্ত করা। এখন সেই কমিশন যারা গঠন করবেন, সেই বাছাই কমিটিতে যদি সরকারের শীর্ষ আমলা বা মন্ত্রিপরিষদ সচিব থাকেন, তবে নিরপেক্ষ লোক নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ৯ নভেম্বরের অধ্যাদেশে বাছাই কমিটিতে আমলাদের না রাখাটা ছিল সরকারের সদিচ্ছার পরিচায়ক। কিন্তু এক মাসের মাথায় ইউ-টার্ন নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে কমিশনকে আবারও সরকারি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। এটি কমিশনের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

যদিও ‘জাতীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিভাগ’ বা এনপিএম গঠন প্রশংসনীয় উদ্যোগ, কিন্তু টিআইবি মনে করে, বাছাই কমিটিতে আমলাতান্ত্রিক উপস্থিতির কারণে এই ভালো উদ্যোগটিও ভেস্তে যেতে পারে। কারণ, এই এনপিএম বিভাগের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগ দেবে সেই কমিশন, যা আমলা-নিয়ন্ত্রিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে গঠিত হবে। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যারা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার করবেন, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরকারেরই নিয়ন্ত্রণ থাকায়, তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। অর্থাৎ, সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ধারা ১৬-তে ‘অবহিত করা যাইবে’ শব্দগুচ্ছের ব্যবহারকে মানবাধিকারকর্মীরা অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করছেন। এর ফলে মানবাধিকার কমিশন যদি কোনো গুরুতর অন্যায়ের প্রতিকার চায় বা সুপারিশ করে, প্রশাসন চাইলে তা উপেক্ষা করতে পারবে এবং এর জন্য তাদের কোনো আইনি জবাবদিহিতার মুখে পড়তে হবে না। টিআইবির মতে, এই একটি পরিবর্তনের মাধ্যমেই কমিশনের ক্ষমতাকে নখদন্তহীন করে ফেলা হয়েছে। এটি কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাকে আইনি বৈধতা দেওয়ার শামিল।

যেকোনো আইন বা অধ্যাদেশ প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া গণতান্ত্রিক রীতি। টিআইবি অভিযোগ করেছে, ৯ নভেম্বরের অধ্যাদেশের পর অংশীজনরা যখন আশান্বিত হয়েছিলেন, তখন কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই গোপনে ৮ ডিসেম্বর এই সংশোধনী আনা হয়েছে। একে তারা ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ ও ‘অন্তর্ঘাতমূলক’ সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন। সংস্কারের নামে কিছু পরিবর্তন আনা হলেও, মূল নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার পুরোনো আমলাতান্ত্রিক কৌশলই এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে মানবাধিকার সুরক্ষার নতুন অধ্যায় সূচিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাছাই কমিটিতে আমলাতন্ত্রের পুনঃপ্রবেশ ও সরকারের জবাবদিহিতা শিথিল করার মাধ্যমে সেই সম্ভাবনায় বড় ধরনের ছেদ পড়েছে। স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (প্যারিস প্রিন্সিপল) অনুযায়ী কমিশন গঠন করতে হলে, কমিশনকে অবশ্যই নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।

এনপিএম-এর মতো শক্তিশালী কাঠামো তখনই কার্যকর হবে, যখন এর পরিচালকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। টিআইবি ও সচেতন মহল তাই অবিলম্বে এই অধ্যাদেশ পুনর্বিবেচনার ও নতুন করে ঢেলে সাজানোর দাবি জানাচ্ছে। অন্যথায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আবারও একটি ‘কাগুজে বাঘ’ বা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার বা প্রতিকারে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারবে না।

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত