আজ ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস। নারীশিক্ষা, নারী অধিকার, মানবাধিকার ও নারী জাগরণে অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৪৫তম জন্ম ও ৯৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজ রোকেয়া বেঁচে থাকলে কী করতেন বা বলতেন?
সামিয়া রহমান

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও যখন বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারত-কন্যাদের যাপিত জীবন নিয়ে ‘অবরোধবাসিনী’ লিখেছিলেন, তখন নারীর অবস্থা ছিল দৃশ্যমান পর্দায় বন্দি, ঘর-সংসারের চার দেয়ালের মধ্যে আটকে থাকা, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এবং সামাজিক নিয়ম-নিষেধের শেকলে বাঁধা। তিনি যে ব্রিটিশ ভারতের ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অবরোধের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, সেটি ছিল সরাসরি দমন আর নারীর স্বাধীন চলাফেরা ও চিন্তা করার অধিকারকে অস্বীকার করা সামাজিক শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।
রোকেয়ার মৃত্যুর এক শতাব্দী পর এখন আমরা অনেক পরিবর্তন দেখছি। নারীরা এখন পড়াশোনা করে, চাকরি করে, নেতৃত্ব দেয়, মহাকাশে যায়, প্রযুক্তি আবিষ্কার করে—যা একসময় ছিল রোকেয়ার স্বপ্ন। দূরের সেই পুরনো দিনে যে মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারত না, তাঁরা আজ নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলছে। কিন্তু এই দৃশ্যমান পরিবর্তন কি সত্যিকারের মুক্তি? নাকি বাস্তবতা আরও জটিল?
আজকের সমাজ নারীর ওপর যে চাপ সৃষ্টি করে, যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, যে প্রত্যাশা চাপিয়ে দেয়, সেসব কি আগের সেই পর্দার চেয়েও সূক্ষ্ম নয়? বেগম রোকেয়ার ভাষ্যমতে ‘আমরা কোথা হইতে আসিয়া কোথায় গিয়া পড়িয়াছি!’ প্রকৃতপক্ষে, আজকের নারীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অদৃশ্য অবরোধ, যা চোখে দেখা যায় না; কিন্তু নারীকে প্রতিদিন সীমাবদ্ধ করে, অস্থির করে, চাপ দেয় এবং ধীরে ধীরে দমিয়ে রাখে। পুরোনো অবরোধ ছিল বাহ্যিক, কিন্তু নতুন অবরোধ হলো মানসিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং সমাজের গভীর কাঠামোর অঙ্গ; তাই এগুলো ভাঙা আরও কঠিন।
আজকের নারীকে আমরা দেখি শহরের রাস্তায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, অফিসে। কিন্তু তাঁদের চলাফেরার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর সমাজের একটি অদৃশ্য নজরদারি কাজ করে। তাঁকে বলা হয় কীভাবে হাঁটবে, কীভাবে বসবে, কী পোশাক পরবে, কখন বাইরে যাবে, কার সঙ্গে কথা বলবে, রাতে কতটা দেরি পর্যন্ত কাজ করতে পারবে এসব পরামর্শ, নিষেধাজ্ঞা, মন্তব্য ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। এসব আসলে নতুন ধরনের অবরোধ, যাকে ভাঙা আগের চেয়ে অনেক কঠিন।
কারণ এগুলো আর শিকল নয়, বাস্তব কোনো দেয়াল নয়, বরং সমাজের বদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবারের অঘোষিত নিয়ম, কর্মস্থলের অদৃশ্য বৈষম্য আর পুরুষতান্ত্রিক চেতনার গভীর রূপ।

একসময় নারীর ভূমিকা নির্ধারিত ছিল গৃহিণী, মা, পাত্রী হিসেবে। এখনও সেগুলো টিকে আছে; শুধু এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন প্রত্যাশা। এখন নারীকে বলা হয় ‘তুমি পড়াশোনা করবে, ক্যারিয়ার করবে, কিন্তু ঘরের সব কাজও করবে, সবার যত্ন নেবে, সামাজিকভাবে শালীন থাকবে, গায়ের রঙের মানদণ্ড মানবে, শরীরের সৌন্দর্য ধরে রাখবে আবার সবসময় হাসিখুশি থাকবে।’ এই দ্বৈত বা বহুবিধ প্রত্যাশাই নারীর অদৃশ্য কারাগার, যেখানে তাঁকে একইসঙ্গে সবকিছু হতে হবে, কিন্তু নিজের মতো করে কিছুই হতে দেওয়া হবে না।
প্রযুক্তির যুগে নারীর ওপর তৈরি হয়েছে আরেক ধরনের পর্দা, যাকে বলা যায় ‘ডিজিটাল অবরোধ’। সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে নিয়মিত বিচার করা হয়: কী পোশাক পরেছে, কী মতামত দিয়েছে, কোন ছবি পোস্ট করেছে। ট্রলিং, স্টকিং, সাইবার বুলিং, ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে চরিত্রহনন এসব আধুনিক সমাজের নতুন পর্দা। তীব্র প্রতিক্রিয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার ভয়ে অনেক মেয়ে অনলাইনে নিজেদের মত প্রকাশ করতে ভয় পায়। এভাবেই ডিজিটাল সমাজে নারীর উপর তৈরি হয় অদৃশ্য পর্দা যা শারীরিক নয়, কিন্তু তা মনে ভয়ের সৃষ্টি করে।
বেগম রোকেয়া হয়ত আজ বেঁচে থাকলে বলতেন, পর্দা আর কাপড়ের নয়, এখন পর্দা চোখের। সেই চোখ সাইবার চোখ, সামাজিক চোখ, সমালোচনার চোখ। যে সমাজ একসময় নারীর মুখ ঢেকে রাখতে চাইত, সেই সমাজ এখন তাকে আরও কঠিনভাবে ঢেকে রাখতে চায় তার মতামত, স্বাধীনতা, উপস্থিতি আর ডিজিটাল পরিচয়।
কর্মক্ষেত্রেও নারীর উন্নতির পথ একেবারে মসৃণ নয়। কখনো কখনো মনে হয়, বাহ্যিকভাবে মেয়েদের সুযোগ আছে, কিন্তু উচ্চপদে উঠতে গেলে অনেক সময় অদৃশ্য বাধায় আটকে যায়। আমরা যাকে বলি ‘গ্লাস সিলিং’। নারী যত যোগ্যই হোক, নেতৃত্বের পদ, সিদ্ধান্ত–নির্ধারণের স্থান, অর্থনৈতিক ক্ষমতার জায়গাগুলো আজও পুরুষদের দখলে। কর্মস্থলে মাতৃত্ব আজও অনেক প্রতিষ্ঠানে বাধা হিসেবে দেখা হয়। একজন পুরুষ যদি বাবা হয়, তবে তাকে দায়িত্বশীল হিসেবে দেখা হয়; কিন্তু একজন নারী মা হলে তার পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এ সমাজের আরেকটি বড় অদৃশ্য কারাগার হলো সৌন্দর্যের মানদণ্ড। রোকেয়ার সময় নারীর শারীরিক উপস্থিতিকে লুকিয়ে রাখা হতো; আজ নারীর শরীরকে প্রকাশ্যে বিচার করা হয়। সৌন্দর্যের নাম করে তাকে বলা হয় ‘ফর্সা হও, রোগা হও, মেকআপ করো, কিন্তু আবার অত সাজলে অশোভন।’ নারী যেন নিজের শরীরের মালিক নন। তাই সমাজ তাঁকে নির্দেশ দেয় কেমন দেখতে হলে তাকে ‘গ্রহণযোগ্য’ মনে হবে।
বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা, ফ্যাশন সবখানেই নারীর শারীরিক রূপকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় এক আদর্শ, যা পূরণ করতে গিয়ে নারী নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এটি মানসিকভাবে নারীর উপর তৈরি করে সূক্ষ্ম চাপ, এক ধরনের অদৃশ্য অবরোধ, যা তাকে নিজের অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে।
পরিবারের মধ্যেও নারীর জন্য তৈরি হয় নানা অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ। মেয়ে বেশি পড়াশোনা করলে ‘বিয়ে হবে না’, বেশি হাসলে ‘চরিত্র ভালো না’, বেশি আত্মবিশ্বাস দেখালে ‘অতিরিক্ত আধুনিক’, নিজের মতামত দিলে ‘বিপজ্জনক’। রোকেয়ার সময় নারীর শিক্ষার পথে সরাসরি বাধা ছিল; এখন সেই বাধা নরম হয়ে এসেছে, কিন্তু কম বিপজ্জনক নয়। মেয়েদের বলা হয় তারা সব করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতিটি সাফল্যের বিপরীতে দিতে হয় দ্বিগুণ প্রমাণ। নারীর ওপর সামাজিক প্রত্যাশা এতটাই গভীর যে অনেক নারী নিজের মধ্যেই তৈরি করে নিজস্ব কারাগার। আত্মসন্দেহ, আত্মগ্লানি, স্বপ্নের প্রতি ভীতি এসবই অদৃশ্য অবরোধের ফল।
তাহলে প্রশ্ন হলো আজ রোকেয়া বেঁচে থাকলে কী করতেন বা বলতেন ? তিনি বলতেন নারীর মুক্তি শুধু ঘরের পর্দা সরানো নয়; নারীর মুক্তির মূল জায়গা তার চিন্তা, আত্মবিশ্বাস, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মর্যাদা। তিনি হয়তো বলতেন, বিদ্যাকে মুক্ত করো, মনকে মুক্ত করো, সমাজের চোখকে মুক্ত করো।
রোকেয়া হয়তো আরও বলতেন, আইন করে সমাজকে পাল্টানো যায় না, পাল্টাতে হয় মন-মানসিকতা, শিক্ষা, পরিবার, সংস্কৃতিকে। তিনি প্রযুক্তিকে নারীর ক্ষমতায়নের হাতিয়ার বানাতে চাইতেন। ডিজিটাল প্রাইভেসিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে দাবি করতেন। নারীর অর্থনৈতিক শক্তিকে তিনি স্বাধীনতার মূলে স্থাপন করতেন, যা তিনি আগেও চেয়েছিলেন। নারী, নারীশিক্ষা, নারীর মুক্তির প্রশ্নে বেগম রোকেয়া বিশ শতকেও যেমন প্রাসঙ্গিক ছিলেন আজ শতবর্ষ পরেও তিনি ঠিক একইভাবে প্রাসঙ্গিক।
আজ বেগম রোকেয়ার জন্মদিনে আমরা তাই স্মরণ করি নারীর মুক্তির সংগ্রাম শেষ হয়নি; বরং তার রূপ বদলেছে। আগের শেকল ছিল লোহার, এখন শেকল হলো চিন্তার, সংস্কৃতির, প্রযুক্তির, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির। এই অদৃশ্য অবরোধ ভাঙতে হলে প্রয়োজন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষায় সমতা, নারীর প্রতি সম্মান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আর সামাজিক মানসিকতার আমূল পরিবর্তন।
রোকেয়ার সংগ্রাম ছিল নারীর অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার; আজকের সংগ্রাম সেই স্বীকৃতিকে কার্যকর, বাস্তব ও মর্যাদাবান করে তোলার। অদৃশ্য অবরোধ ভাঙার লড়াই তাই শুধু নারীর নয় সমাজের, মানবতার, সভ্যতার।
লেখক: সামিয়া রহমান, প্রাবন্ধিক: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও যখন বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারত-কন্যাদের যাপিত জীবন নিয়ে ‘অবরোধবাসিনী’ লিখেছিলেন, তখন নারীর অবস্থা ছিল দৃশ্যমান পর্দায় বন্দি, ঘর-সংসারের চার দেয়ালের মধ্যে আটকে থাকা, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এবং সামাজিক নিয়ম-নিষেধের শেকলে বাঁধা। তিনি যে ব্রিটিশ ভারতের ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অবরোধের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন, সেটি ছিল সরাসরি দমন আর নারীর স্বাধীন চলাফেরা ও চিন্তা করার অধিকারকে অস্বীকার করা সামাজিক শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ।
রোকেয়ার মৃত্যুর এক শতাব্দী পর এখন আমরা অনেক পরিবর্তন দেখছি। নারীরা এখন পড়াশোনা করে, চাকরি করে, নেতৃত্ব দেয়, মহাকাশে যায়, প্রযুক্তি আবিষ্কার করে—যা একসময় ছিল রোকেয়ার স্বপ্ন। দূরের সেই পুরনো দিনে যে মেয়েরা ঘরের বাইরে যেতে পারত না, তাঁরা আজ নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলছে। কিন্তু এই দৃশ্যমান পরিবর্তন কি সত্যিকারের মুক্তি? নাকি বাস্তবতা আরও জটিল?
আজকের সমাজ নারীর ওপর যে চাপ সৃষ্টি করে, যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, যে প্রত্যাশা চাপিয়ে দেয়, সেসব কি আগের সেই পর্দার চেয়েও সূক্ষ্ম নয়? বেগম রোকেয়ার ভাষ্যমতে ‘আমরা কোথা হইতে আসিয়া কোথায় গিয়া পড়িয়াছি!’ প্রকৃতপক্ষে, আজকের নারীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অদৃশ্য অবরোধ, যা চোখে দেখা যায় না; কিন্তু নারীকে প্রতিদিন সীমাবদ্ধ করে, অস্থির করে, চাপ দেয় এবং ধীরে ধীরে দমিয়ে রাখে। পুরোনো অবরোধ ছিল বাহ্যিক, কিন্তু নতুন অবরোধ হলো মানসিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং সমাজের গভীর কাঠামোর অঙ্গ; তাই এগুলো ভাঙা আরও কঠিন।
আজকের নারীকে আমরা দেখি শহরের রাস্তায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে, অফিসে। কিন্তু তাঁদের চলাফেরার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর সমাজের একটি অদৃশ্য নজরদারি কাজ করে। তাঁকে বলা হয় কীভাবে হাঁটবে, কীভাবে বসবে, কী পোশাক পরবে, কখন বাইরে যাবে, কার সঙ্গে কথা বলবে, রাতে কতটা দেরি পর্যন্ত কাজ করতে পারবে এসব পরামর্শ, নিষেধাজ্ঞা, মন্তব্য ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। এসব আসলে নতুন ধরনের অবরোধ, যাকে ভাঙা আগের চেয়ে অনেক কঠিন।
কারণ এগুলো আর শিকল নয়, বাস্তব কোনো দেয়াল নয়, বরং সমাজের বদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবারের অঘোষিত নিয়ম, কর্মস্থলের অদৃশ্য বৈষম্য আর পুরুষতান্ত্রিক চেতনার গভীর রূপ।

একসময় নারীর ভূমিকা নির্ধারিত ছিল গৃহিণী, মা, পাত্রী হিসেবে। এখনও সেগুলো টিকে আছে; শুধু এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন প্রত্যাশা। এখন নারীকে বলা হয় ‘তুমি পড়াশোনা করবে, ক্যারিয়ার করবে, কিন্তু ঘরের সব কাজও করবে, সবার যত্ন নেবে, সামাজিকভাবে শালীন থাকবে, গায়ের রঙের মানদণ্ড মানবে, শরীরের সৌন্দর্য ধরে রাখবে আবার সবসময় হাসিখুশি থাকবে।’ এই দ্বৈত বা বহুবিধ প্রত্যাশাই নারীর অদৃশ্য কারাগার, যেখানে তাঁকে একইসঙ্গে সবকিছু হতে হবে, কিন্তু নিজের মতো করে কিছুই হতে দেওয়া হবে না।
প্রযুক্তির যুগে নারীর ওপর তৈরি হয়েছে আরেক ধরনের পর্দা, যাকে বলা যায় ‘ডিজিটাল অবরোধ’। সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে নিয়মিত বিচার করা হয়: কী পোশাক পরেছে, কী মতামত দিয়েছে, কোন ছবি পোস্ট করেছে। ট্রলিং, স্টকিং, সাইবার বুলিং, ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে চরিত্রহনন এসব আধুনিক সমাজের নতুন পর্দা। তীব্র প্রতিক্রিয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার ভয়ে অনেক মেয়ে অনলাইনে নিজেদের মত প্রকাশ করতে ভয় পায়। এভাবেই ডিজিটাল সমাজে নারীর উপর তৈরি হয় অদৃশ্য পর্দা যা শারীরিক নয়, কিন্তু তা মনে ভয়ের সৃষ্টি করে।
বেগম রোকেয়া হয়ত আজ বেঁচে থাকলে বলতেন, পর্দা আর কাপড়ের নয়, এখন পর্দা চোখের। সেই চোখ সাইবার চোখ, সামাজিক চোখ, সমালোচনার চোখ। যে সমাজ একসময় নারীর মুখ ঢেকে রাখতে চাইত, সেই সমাজ এখন তাকে আরও কঠিনভাবে ঢেকে রাখতে চায় তার মতামত, স্বাধীনতা, উপস্থিতি আর ডিজিটাল পরিচয়।
কর্মক্ষেত্রেও নারীর উন্নতির পথ একেবারে মসৃণ নয়। কখনো কখনো মনে হয়, বাহ্যিকভাবে মেয়েদের সুযোগ আছে, কিন্তু উচ্চপদে উঠতে গেলে অনেক সময় অদৃশ্য বাধায় আটকে যায়। আমরা যাকে বলি ‘গ্লাস সিলিং’। নারী যত যোগ্যই হোক, নেতৃত্বের পদ, সিদ্ধান্ত–নির্ধারণের স্থান, অর্থনৈতিক ক্ষমতার জায়গাগুলো আজও পুরুষদের দখলে। কর্মস্থলে মাতৃত্ব আজও অনেক প্রতিষ্ঠানে বাধা হিসেবে দেখা হয়। একজন পুরুষ যদি বাবা হয়, তবে তাকে দায়িত্বশীল হিসেবে দেখা হয়; কিন্তু একজন নারী মা হলে তার পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এ সমাজের আরেকটি বড় অদৃশ্য কারাগার হলো সৌন্দর্যের মানদণ্ড। রোকেয়ার সময় নারীর শারীরিক উপস্থিতিকে লুকিয়ে রাখা হতো; আজ নারীর শরীরকে প্রকাশ্যে বিচার করা হয়। সৌন্দর্যের নাম করে তাকে বলা হয় ‘ফর্সা হও, রোগা হও, মেকআপ করো, কিন্তু আবার অত সাজলে অশোভন।’ নারী যেন নিজের শরীরের মালিক নন। তাই সমাজ তাঁকে নির্দেশ দেয় কেমন দেখতে হলে তাকে ‘গ্রহণযোগ্য’ মনে হবে।
বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা, ফ্যাশন সবখানেই নারীর শারীরিক রূপকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় এক আদর্শ, যা পূরণ করতে গিয়ে নারী নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এটি মানসিকভাবে নারীর উপর তৈরি করে সূক্ষ্ম চাপ, এক ধরনের অদৃশ্য অবরোধ, যা তাকে নিজের অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে।
পরিবারের মধ্যেও নারীর জন্য তৈরি হয় নানা অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ। মেয়ে বেশি পড়াশোনা করলে ‘বিয়ে হবে না’, বেশি হাসলে ‘চরিত্র ভালো না’, বেশি আত্মবিশ্বাস দেখালে ‘অতিরিক্ত আধুনিক’, নিজের মতামত দিলে ‘বিপজ্জনক’। রোকেয়ার সময় নারীর শিক্ষার পথে সরাসরি বাধা ছিল; এখন সেই বাধা নরম হয়ে এসেছে, কিন্তু কম বিপজ্জনক নয়। মেয়েদের বলা হয় তারা সব করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতিটি সাফল্যের বিপরীতে দিতে হয় দ্বিগুণ প্রমাণ। নারীর ওপর সামাজিক প্রত্যাশা এতটাই গভীর যে অনেক নারী নিজের মধ্যেই তৈরি করে নিজস্ব কারাগার। আত্মসন্দেহ, আত্মগ্লানি, স্বপ্নের প্রতি ভীতি এসবই অদৃশ্য অবরোধের ফল।
তাহলে প্রশ্ন হলো আজ রোকেয়া বেঁচে থাকলে কী করতেন বা বলতেন ? তিনি বলতেন নারীর মুক্তি শুধু ঘরের পর্দা সরানো নয়; নারীর মুক্তির মূল জায়গা তার চিন্তা, আত্মবিশ্বাস, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মর্যাদা। তিনি হয়তো বলতেন, বিদ্যাকে মুক্ত করো, মনকে মুক্ত করো, সমাজের চোখকে মুক্ত করো।
রোকেয়া হয়তো আরও বলতেন, আইন করে সমাজকে পাল্টানো যায় না, পাল্টাতে হয় মন-মানসিকতা, শিক্ষা, পরিবার, সংস্কৃতিকে। তিনি প্রযুক্তিকে নারীর ক্ষমতায়নের হাতিয়ার বানাতে চাইতেন। ডিজিটাল প্রাইভেসিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে দাবি করতেন। নারীর অর্থনৈতিক শক্তিকে তিনি স্বাধীনতার মূলে স্থাপন করতেন, যা তিনি আগেও চেয়েছিলেন। নারী, নারীশিক্ষা, নারীর মুক্তির প্রশ্নে বেগম রোকেয়া বিশ শতকেও যেমন প্রাসঙ্গিক ছিলেন আজ শতবর্ষ পরেও তিনি ঠিক একইভাবে প্রাসঙ্গিক।
আজ বেগম রোকেয়ার জন্মদিনে আমরা তাই স্মরণ করি নারীর মুক্তির সংগ্রাম শেষ হয়নি; বরং তার রূপ বদলেছে। আগের শেকল ছিল লোহার, এখন শেকল হলো চিন্তার, সংস্কৃতির, প্রযুক্তির, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির। এই অদৃশ্য অবরোধ ভাঙতে হলে প্রয়োজন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষায় সমতা, নারীর প্রতি সম্মান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আর সামাজিক মানসিকতার আমূল পরিবর্তন।
রোকেয়ার সংগ্রাম ছিল নারীর অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার; আজকের সংগ্রাম সেই স্বীকৃতিকে কার্যকর, বাস্তব ও মর্যাদাবান করে তোলার। অদৃশ্য অবরোধ ভাঙার লড়াই তাই শুধু নারীর নয় সমাজের, মানবতার, সভ্যতার।
লেখক: সামিয়া রহমান, প্রাবন্ধিক: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়

আজকাল ‘ইন্ট্রোভার্ট’ শব্দটা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয়। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অনেকে জানান দেয়, ‘আমি ইন্ট্রোভার্ট’। কেন এত মানুষ কেন নিজেকে ইন্ট্রোভার্ট ভাবতে ভালোবাসে? অনেকে কি আবার ভুল করে নিজেকে ইন্ট্রোভার্ট ভাবে? এখানে ট্রেন্ড, ব্যাখা আর ভুল ধারণা কোথায়?
১০ ঘণ্টা আগে
আজ ৮ ডিসেম্বর জন লেননের মৃত্যুদিন। দুনিয়া কাঁপানো ব্যান্ড বিটলস-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য লেনন ছিলেন একাধারে গায়ক, গীতিকার, সুরকার, চিত্রশিল্পী, লেখক ও শান্তিকর্মী। ‘ইমাজিন’ তাঁর বিখ্যাত গান। এই গানে তিনি কোন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছেন? কেন গানটি আজও এত প্রাসঙ্গিক?
১ দিন আগে
বর্তমান বিশ্বে সাহসী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁর নাম সবার আগে আসে, তিনি নোম চমস্কি। ৭ ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। একদিকে তিনি আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের স্থপতি, অন্যদিকে শোষিতের পক্ষে দাঁড়ানো এক অকুতোভয় যোদ্ধা। খুঁজে দেখা যাক আধুনিক সময়ের অন্যতম প্রধান চিন্তক ও জনবুদ্ধিজীবী নোম চমস্কির বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম।
১ দিন আগে
শুনতে অবাক লাগলেও এমন ঘটনাই ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। যদিও ইতিহাসের পাতায় কচুরিপানা নিয়ে খুব কমই লেখা হয়েছে, কিন্তু কচুরিপানার অবদান অস্বীকার কোনো উপায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল বারুদ আর রক্তের ইতিহাস নয়। এটি ছিল বাংলার মাটি, জল ও প্রকৃতির এক সম্মিলিত সংগ্রাম।
১ দিন আগে