জেনে অবাক হবেন যে রাজশাহীর জঙ্গলে শেষ বাঘটি দেখা যায় ১২৫ বছর আগে। শত বছর আগেও বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে বন্যপ্রাণী বাস করত। কোন কোন বন্যপ্রাণী সেখানে ছিল? নদী, জলাভূমি ও পুকুরে কী কী মাছ পাওয়া যেত? কী কী পাখি দেখা যেত? ১৯১৬ সালে প্রকাশিত এল এস এস ওম্যালি-এর বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার (রাজশাহী) থেকে অনুবাদ করেছেন ভূ-পর্যটক তারেক অণু।
তারেক অণু

১৮৬৬ সালের দিকেও রাজশাহীর চরাঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি। সেই জঙ্গলের বিবরণ সিমসনের ‘স্পোর্ট ইন ইস্টার্ন বেঙ্গল’ (১৮৮৬) বইতে পাওয়া যায়। জনাব সিমসন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য ছিলেন। ১৮৫০ সালে তিনি জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্র হিসেবে রাজশাহীতে আসেন। তাঁর বইতে জানা যায়, সেই আমলে পদ্মার চর ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি। শুধুমাত্র নীল চাষের জন্য ব্যবহৃত কিছু পরিষ্কার করা জায়গা ছাড়া নানা ঝোপঝাড়, নলখাগড়ায় ভরা ছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
অনেক জায়গাতেই জঙ্গল এতটাই দুর্ভেদ্য ছিল যে পালা হাতির পালের সাহায্য ছাড়া সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। চর ভর্তি থাকত বুনো মহিষে। সাধারণত এদের ‘স্যাডল’ থেকে ‘হর্স পিস্তল’ বা অন্য আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে শিকার করা হত। ১৮৬০ সালের দিকে ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার হ্যারি ডেভেরেল চর সোনাইকান্দিতে অত্র এলাকার শেষ বুনো মহিষটি শিকার করেন।
বরেন্দ্র ভূমি (বরিন) ছিল শিকারের জন্য আদর্শ। সেখানে বাঘের দেখাও মিলত। জনাব সিমসনের মতে তাল, বাঁশ এবং অন্যান্য স্থানীয় গাছের সমন্বয়ে সেখানে ছিল বিশাল জঙ্গল। জঙ্গল ছিল নানা প্রাণীর লুকিয়ে থাকার জন্য আদর্শ জায়গা। বরেন্দ্র অঞ্চল এতটাই অগম্য আর ঝামেলাপূর্ণ ছিল যে অধিকাংশ শিকারি এই এলাকাকে সুনজরে দেখতেন না।
ফলে শিকারের অধিকাংশ প্রাণীই এখানে নির্বিঘ্নে প্রজনন করত বছরের পর বছর। মাঝে মাঝেই হরিণ, বুনো শুয়োর গ্রামে নেমে আসত। ঘাস ও ঝোপে আশ্রয় নিয়ে তারা সবুজ ফসলে হামলা দিত। আবার পোষা হাতির পালের তাড়া খেলেই ফের বরেন্দ্র এলাকায় পালিয়ে যেত। পানির উৎস এবং বরেন্দ্র এলাকার মাঝেই চরে বেড়াত হরিণ, যার পিছু নিত বাঘ ও চিতাবাঘ।
কালা-তিতির ও হরিণেরা ঘাসের জঙ্গলে আস্তানা গাড়ত। চিকোর নামের বাতাই জাতীয় পাখিটি ঝোপে, কাদাখোঁচা এবং সব জাতের বুনোহাঁসেরা জলের কাছেই থাকত। বরেন্দ্র অঞ্চলে যে একটিমাত্র শিকারের প্রাচুর্য ছিল তা হচ্ছে চিত্রা হরিণ এবং ময়ূর, যা সিমসন বাংলার আর কোথাও শিকার করেন নি। সিমসন জীবনে এখানেই প্রথম বাঘ দেখেন। মহানন্দা তীরের অভয়া নামের এক পুরাতন নীল কারখানা ঘুরে দেখার পর জনাব সিমসন সেই পানিপূর্ণ উপত্যকায় ঘুরে দেখেন এবং তাঁর রোজনামচায় শিকারের তালিকা লিপিবদ্ধ করেন—৪টি হরিণ, ৯টি বাতাই, দুইজোড়া চাপাখি, ২টি বুনোহাঁস এবং একটি আহত বাঘ!
৫০ বছর আগে (১৯১৬ সালে প্রকাশিত লেখা, অর্থাৎ এখানে ১৯৬৬ সালের কথা বলা হচ্ছে) রাজশাহী অঞ্চল বুনো মহিষ, বাঘ, চিতাবাঘ, বুনো শুয়োর, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণে ভরা ছিল। ক্ষুদে শিকারদের মধ্যে ছিল খরগোশ, ময়ূর, কালা-তিতির, বাদা-তিতির, বৃষ্টি-বটেরা, পাতি-ডাহর, নানা জাতের বুনোহাঁস, বনমুরগি, কাদাখোঁচার দল। এতসব প্রাণী মধ্যে কেবল চিতাবাঘ এবং বুনো শুয়োরেরাই টিকে আছে (১৯১৬ সালের কথা) গ্রামের জঙ্গলগুলোতে, বাকিরা কৃষিকাজের জন্য জঙ্গল সাফ করার জন্য হারিয়ে গেছে চিরতরে। পাখিদের মধ্যে অবশ্য অবস্থা কিছুটা ভাল, কেবল ময়ূর আর বাদা-তিতিরেরাই হারিয়ে গেছে। অল্প কয়েকটি কালা-তিতির আর পাতি-ডাহরের দেখা মেলে মাঝে মাঝে, আর বুনোহাঁস, বনমুরগি, কাদাখোঁচার দল আগের মতোই আছে।
১৮৯০-এর দশক পর্যন্ত বাঘ টিকে ছিল। গোদাগারীর ওপারের বারিন্দ অঞ্চলে মুর্শিদাবাদের নবাব প্রতি বছরই বাঘের খোঁজে শিকারের আয়োজন করতেন। এমনকি ১৮৯৪ সালেও রাজশাহীর কালেক্টর এবং আরেকজন শিকারি রামপুর বোয়ালিয়ার মাত্র তিন মাইলের মধ্যে কয়েকটি বাঘ হত্যা করেন। আর শেষ বাঘটি দেখা গিয়েছিল ১৯০০ সালে খরচাকাতে।
চিতাবাঘেরা এখনও (১৯১৬ সালের কথা বলা হচ্ছে) আগের মতই প্রবল বিক্রমে সাহসিকতার সঙ্গে টিকে আছে। রামপুর-বোয়ালিয়ার (রাজশাহী শহরের প্রাচীন নাম) কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রাচীরে ওঠার চেষ্টা করার সময় ১৯০৭ সালে একটি চিতাবাঘকে গুলি করা হয়। এছাড়া ১৯১৫ সালেও একটি চিতাবাঘকে শহরে দেখা গিয়েছিল। একবার জানা যায়, একটি চিতাবাঘ নরখাদকে পরিণত হয়েছে এবং রাজাপুর পুলিশ পোস্টের এলাকার চারজন মানুষকে শিকার করেছে। অধিকাংশ চিতাবাঘই ছিল ছোট আকৃতির, জেলার অসংখ্য ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের ছোট ছোট খণ্ডে বিচরণ করে। রামপুর-বোয়ালিয়া থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত শিরইল গ্রামে এদের প্রায়ই ফাঁদ পেতে ধরা হত। সেখানে অনেক বনবেড়ালও দেখা যেত। বুনো বিড়ালের অন্যান্য প্রজাতি, শিয়াল, খেঁকশেয়াল ও খরগোশও এখানে বেশ সংখ্যায় পাওয়া যেত
বুনো শুয়োরের বিচরণ ছিল সর্বত্র, বিশেষ করে নদীর চরে। এক হিসেবে তারা আসলেই কোনো কোনো জনপদে হামলা করত আর রাতের বেলা ধান ও আঁখখেতের চরম ক্ষতিসাধন করত। এমনকি কাদায় আটকা পড়া গবাদিপশুদের ক্ষতি করার ঘটনাও শোনা গেছে।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সব শেষে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন। গঙ্গা, আত্রাই নদী ও চলন বিলের গভীর অঞ্চলেও তাদের সহজে দেখা যেত।
শীতকালে নদী জলাঞ্চলে নানা জাতের পরিযায়ী পাখিরা আসত। চলন বিল, নওগাঁর ছয় মাইল দক্ষিনের দুবলহাটি বিল এবং মধুয়ানগর রেলষ্টেশনের কাছে অবস্থিত হালতি বিলে বুনোহাঁসের মেলা বসতো। চা-পাখি, চ্যাগা এবং কাদাখোঁচারা বিলে এবং বাদা জুড়ে থাকতো সারা জেলাতে। বড় চর এবং পদ্মার বালির চরে রাজহাঁস শিকার করা যেত, যেখানে মদনটাক ও গগণবেড়দের দেখাও মিলত। অন্যান্য জলচর পাখিদের মধ্যে পানমুরগি, কুট, সারস, বক, জিরিয়া, বাটান ইত্যাদি নদী ও বিলে দেখা যেত। হরিয়ালও দেখা যেত প্রচুর, এছাড়া কালা-তিতির, বাদা-তিতির, বৃষ্টি-বটেরা এবং পাতি-ডাহর ১৯১৬ সালের দিকেও টিকে ছিল।
গেম-বার্ড বা শিকারের জন্য জনপ্রিয় পাখি বাদেও অন্যান্য নানা জাতের পাখি এই জেলায় অনেক ছিল। এখানের শকুনেরা পশ্চিমের শকুনের তুলনার বিশালকায় ছিল। তারা গাছের ডালে বসে খাবারের অপেক্ষায় থাকে দিনমান, এদের ধৈর্যের অভাব নেই। আবার এদের জন্য পচা-গলার খাবারের অভাব হয় না। বিল এবং নদীতে মেছো-ঈগলের রাজত্ব ছিল।
কোকিল পরিবারের মধ্যে কানাকুয়ো (এটি মোটেও কোকিল নয়, তখন ভুল ভাবা হত) এবং দেশী-কোকিলের ডাকই সবচেয়ে বেশি শোনা যেত। রাতে সবসময়ই শোনা যেত রাতচরার ডাক, বরফের মাঝে পাথর পড়ার মত শব্দ তুলে অবিরাম অস্তিত্ব জানান দিত।
বিশাল সব নদী ও বিলের কারণে এই জেলাতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। পদ্মা নদী থেকে পাওয়া মাছের দাম এক বছরে অন্তত দুই লাখ তো হবেই, সেই সঙ্গে আছে আত্রাই থেকে পাওয়া মাছ! পদ্মার ইলিশ নামের অসাধারণ স্বাদের মাছটি ধরা পড়ে প্রচুর পরিমাণে। অন্যান্য মাছের মধ্যে রুই, কালবাউশ, কাতলা সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়া মৃগেল, বোয়াল, মাগুর, আইড়, ট্যাংরা, বাছা ইত্যাদি মাছও বেশ সুস্বাদু এবং যথেষ্টই ধরা পড়ে। মাগুর এবং কই স্বাদু পানির মাছ যাদের সাধারণত একটু ময়লা পানিতেই দেখা মেলে। কই মাছ আবার কানকো ব্যবহার করে ডাঙ্গায় উঠতে পারে। দুবলাহাটির বিলের কই অতি বিখ্যাত। ইতিহাস বলে যে এই বিলের ইজারাদার মোঘল আমলে মোঘলদের কর হিসেবে ২০০০০ কই মাছ দিত! মুক্তোওয়ালা ঝিনুক চলন বিল ও পূর্বের নদীগুলোতে মেলে।
উত্তরবঙ্গের পাওয়া সকল সাপই রাজশাহীতে মেলে। সবচেয়ে বেশি দেখা যাওয়া বিষাক্ত সাপগুলোর মধ্যে আছে গোখরা, চন্দ্রবোড়া, কাল-কেউটে, শঙ্খিনী এবং রাজ-গোখরা। রাজ-গোখরা সাধারণত অন্য সাপ খেয়েই বাঁচে, যা সাত থেকে আট ফিট পর্যন্ত লম্বা হয়। নির্বিষ সাপদের মাধ্যে বালুবোয়া, ঘরমৌনী, হেলে ইত্যাদি দেখা যায়, তবে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে জলঢোড়া সাপদের।
নদী ও কিছু জলাধারে দুই ধরনের কুমিরের দেখা মেলে, একটি মাগার কুমির অন্যটি ঘড়িয়াল। মাগার কুমির ১২ ফুটের মত লম্বা হয়, যেখানে মাছখেকো সরু মুখের অধিকারী ঘড়িয়াল হয় আট ফিট। নদীর কচ্ছপ ‘কালি কাইট্ট্যা’ প্রায় সবখানেই মেলে আর নিম্নবর্ণের মানুষেরা সেগুলো খেয়ে থাকে।

১৮৬৬ সালের দিকেও রাজশাহীর চরাঞ্চল ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি। সেই জঙ্গলের বিবরণ সিমসনের ‘স্পোর্ট ইন ইস্টার্ন বেঙ্গল’ (১৮৮৬) বইতে পাওয়া যায়। জনাব সিমসন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য ছিলেন। ১৮৫০ সালে তিনি জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্র হিসেবে রাজশাহীতে আসেন। তাঁর বইতে জানা যায়, সেই আমলে পদ্মার চর ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি। শুধুমাত্র নীল চাষের জন্য ব্যবহৃত কিছু পরিষ্কার করা জায়গা ছাড়া নানা ঝোপঝাড়, নলখাগড়ায় ভরা ছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
অনেক জায়গাতেই জঙ্গল এতটাই দুর্ভেদ্য ছিল যে পালা হাতির পালের সাহায্য ছাড়া সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। চর ভর্তি থাকত বুনো মহিষে। সাধারণত এদের ‘স্যাডল’ থেকে ‘হর্স পিস্তল’ বা অন্য আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে শিকার করা হত। ১৮৬০ সালের দিকে ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার হ্যারি ডেভেরেল চর সোনাইকান্দিতে অত্র এলাকার শেষ বুনো মহিষটি শিকার করেন।
বরেন্দ্র ভূমি (বরিন) ছিল শিকারের জন্য আদর্শ। সেখানে বাঘের দেখাও মিলত। জনাব সিমসনের মতে তাল, বাঁশ এবং অন্যান্য স্থানীয় গাছের সমন্বয়ে সেখানে ছিল বিশাল জঙ্গল। জঙ্গল ছিল নানা প্রাণীর লুকিয়ে থাকার জন্য আদর্শ জায়গা। বরেন্দ্র অঞ্চল এতটাই অগম্য আর ঝামেলাপূর্ণ ছিল যে অধিকাংশ শিকারি এই এলাকাকে সুনজরে দেখতেন না।
ফলে শিকারের অধিকাংশ প্রাণীই এখানে নির্বিঘ্নে প্রজনন করত বছরের পর বছর। মাঝে মাঝেই হরিণ, বুনো শুয়োর গ্রামে নেমে আসত। ঘাস ও ঝোপে আশ্রয় নিয়ে তারা সবুজ ফসলে হামলা দিত। আবার পোষা হাতির পালের তাড়া খেলেই ফের বরেন্দ্র এলাকায় পালিয়ে যেত। পানির উৎস এবং বরেন্দ্র এলাকার মাঝেই চরে বেড়াত হরিণ, যার পিছু নিত বাঘ ও চিতাবাঘ।
কালা-তিতির ও হরিণেরা ঘাসের জঙ্গলে আস্তানা গাড়ত। চিকোর নামের বাতাই জাতীয় পাখিটি ঝোপে, কাদাখোঁচা এবং সব জাতের বুনোহাঁসেরা জলের কাছেই থাকত। বরেন্দ্র অঞ্চলে যে একটিমাত্র শিকারের প্রাচুর্য ছিল তা হচ্ছে চিত্রা হরিণ এবং ময়ূর, যা সিমসন বাংলার আর কোথাও শিকার করেন নি। সিমসন জীবনে এখানেই প্রথম বাঘ দেখেন। মহানন্দা তীরের অভয়া নামের এক পুরাতন নীল কারখানা ঘুরে দেখার পর জনাব সিমসন সেই পানিপূর্ণ উপত্যকায় ঘুরে দেখেন এবং তাঁর রোজনামচায় শিকারের তালিকা লিপিবদ্ধ করেন—৪টি হরিণ, ৯টি বাতাই, দুইজোড়া চাপাখি, ২টি বুনোহাঁস এবং একটি আহত বাঘ!
৫০ বছর আগে (১৯১৬ সালে প্রকাশিত লেখা, অর্থাৎ এখানে ১৯৬৬ সালের কথা বলা হচ্ছে) রাজশাহী অঞ্চল বুনো মহিষ, বাঘ, চিতাবাঘ, বুনো শুয়োর, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণে ভরা ছিল। ক্ষুদে শিকারদের মধ্যে ছিল খরগোশ, ময়ূর, কালা-তিতির, বাদা-তিতির, বৃষ্টি-বটেরা, পাতি-ডাহর, নানা জাতের বুনোহাঁস, বনমুরগি, কাদাখোঁচার দল। এতসব প্রাণী মধ্যে কেবল চিতাবাঘ এবং বুনো শুয়োরেরাই টিকে আছে (১৯১৬ সালের কথা) গ্রামের জঙ্গলগুলোতে, বাকিরা কৃষিকাজের জন্য জঙ্গল সাফ করার জন্য হারিয়ে গেছে চিরতরে। পাখিদের মধ্যে অবশ্য অবস্থা কিছুটা ভাল, কেবল ময়ূর আর বাদা-তিতিরেরাই হারিয়ে গেছে। অল্প কয়েকটি কালা-তিতির আর পাতি-ডাহরের দেখা মেলে মাঝে মাঝে, আর বুনোহাঁস, বনমুরগি, কাদাখোঁচার দল আগের মতোই আছে।
১৮৯০-এর দশক পর্যন্ত বাঘ টিকে ছিল। গোদাগারীর ওপারের বারিন্দ অঞ্চলে মুর্শিদাবাদের নবাব প্রতি বছরই বাঘের খোঁজে শিকারের আয়োজন করতেন। এমনকি ১৮৯৪ সালেও রাজশাহীর কালেক্টর এবং আরেকজন শিকারি রামপুর বোয়ালিয়ার মাত্র তিন মাইলের মধ্যে কয়েকটি বাঘ হত্যা করেন। আর শেষ বাঘটি দেখা গিয়েছিল ১৯০০ সালে খরচাকাতে।
চিতাবাঘেরা এখনও (১৯১৬ সালের কথা বলা হচ্ছে) আগের মতই প্রবল বিক্রমে সাহসিকতার সঙ্গে টিকে আছে। রামপুর-বোয়ালিয়ার (রাজশাহী শহরের প্রাচীন নাম) কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রাচীরে ওঠার চেষ্টা করার সময় ১৯০৭ সালে একটি চিতাবাঘকে গুলি করা হয়। এছাড়া ১৯১৫ সালেও একটি চিতাবাঘকে শহরে দেখা গিয়েছিল। একবার জানা যায়, একটি চিতাবাঘ নরখাদকে পরিণত হয়েছে এবং রাজাপুর পুলিশ পোস্টের এলাকার চারজন মানুষকে শিকার করেছে। অধিকাংশ চিতাবাঘই ছিল ছোট আকৃতির, জেলার অসংখ্য ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের ছোট ছোট খণ্ডে বিচরণ করে। রামপুর-বোয়ালিয়া থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত শিরইল গ্রামে এদের প্রায়ই ফাঁদ পেতে ধরা হত। সেখানে অনেক বনবেড়ালও দেখা যেত। বুনো বিড়ালের অন্যান্য প্রজাতি, শিয়াল, খেঁকশেয়াল ও খরগোশও এখানে বেশ সংখ্যায় পাওয়া যেত
বুনো শুয়োরের বিচরণ ছিল সর্বত্র, বিশেষ করে নদীর চরে। এক হিসেবে তারা আসলেই কোনো কোনো জনপদে হামলা করত আর রাতের বেলা ধান ও আঁখখেতের চরম ক্ষতিসাধন করত। এমনকি কাদায় আটকা পড়া গবাদিপশুদের ক্ষতি করার ঘটনাও শোনা গেছে।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে সব শেষে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন। গঙ্গা, আত্রাই নদী ও চলন বিলের গভীর অঞ্চলেও তাদের সহজে দেখা যেত।
শীতকালে নদী জলাঞ্চলে নানা জাতের পরিযায়ী পাখিরা আসত। চলন বিল, নওগাঁর ছয় মাইল দক্ষিনের দুবলহাটি বিল এবং মধুয়ানগর রেলষ্টেশনের কাছে অবস্থিত হালতি বিলে বুনোহাঁসের মেলা বসতো। চা-পাখি, চ্যাগা এবং কাদাখোঁচারা বিলে এবং বাদা জুড়ে থাকতো সারা জেলাতে। বড় চর এবং পদ্মার বালির চরে রাজহাঁস শিকার করা যেত, যেখানে মদনটাক ও গগণবেড়দের দেখাও মিলত। অন্যান্য জলচর পাখিদের মধ্যে পানমুরগি, কুট, সারস, বক, জিরিয়া, বাটান ইত্যাদি নদী ও বিলে দেখা যেত। হরিয়ালও দেখা যেত প্রচুর, এছাড়া কালা-তিতির, বাদা-তিতির, বৃষ্টি-বটেরা এবং পাতি-ডাহর ১৯১৬ সালের দিকেও টিকে ছিল।
গেম-বার্ড বা শিকারের জন্য জনপ্রিয় পাখি বাদেও অন্যান্য নানা জাতের পাখি এই জেলায় অনেক ছিল। এখানের শকুনেরা পশ্চিমের শকুনের তুলনার বিশালকায় ছিল। তারা গাছের ডালে বসে খাবারের অপেক্ষায় থাকে দিনমান, এদের ধৈর্যের অভাব নেই। আবার এদের জন্য পচা-গলার খাবারের অভাব হয় না। বিল এবং নদীতে মেছো-ঈগলের রাজত্ব ছিল।
কোকিল পরিবারের মধ্যে কানাকুয়ো (এটি মোটেও কোকিল নয়, তখন ভুল ভাবা হত) এবং দেশী-কোকিলের ডাকই সবচেয়ে বেশি শোনা যেত। রাতে সবসময়ই শোনা যেত রাতচরার ডাক, বরফের মাঝে পাথর পড়ার মত শব্দ তুলে অবিরাম অস্তিত্ব জানান দিত।
বিশাল সব নদী ও বিলের কারণে এই জেলাতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। পদ্মা নদী থেকে পাওয়া মাছের দাম এক বছরে অন্তত দুই লাখ তো হবেই, সেই সঙ্গে আছে আত্রাই থেকে পাওয়া মাছ! পদ্মার ইলিশ নামের অসাধারণ স্বাদের মাছটি ধরা পড়ে প্রচুর পরিমাণে। অন্যান্য মাছের মধ্যে রুই, কালবাউশ, কাতলা সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়া মৃগেল, বোয়াল, মাগুর, আইড়, ট্যাংরা, বাছা ইত্যাদি মাছও বেশ সুস্বাদু এবং যথেষ্টই ধরা পড়ে। মাগুর এবং কই স্বাদু পানির মাছ যাদের সাধারণত একটু ময়লা পানিতেই দেখা মেলে। কই মাছ আবার কানকো ব্যবহার করে ডাঙ্গায় উঠতে পারে। দুবলাহাটির বিলের কই অতি বিখ্যাত। ইতিহাস বলে যে এই বিলের ইজারাদার মোঘল আমলে মোঘলদের কর হিসেবে ২০০০০ কই মাছ দিত! মুক্তোওয়ালা ঝিনুক চলন বিল ও পূর্বের নদীগুলোতে মেলে।
উত্তরবঙ্গের পাওয়া সকল সাপই রাজশাহীতে মেলে। সবচেয়ে বেশি দেখা যাওয়া বিষাক্ত সাপগুলোর মধ্যে আছে গোখরা, চন্দ্রবোড়া, কাল-কেউটে, শঙ্খিনী এবং রাজ-গোখরা। রাজ-গোখরা সাধারণত অন্য সাপ খেয়েই বাঁচে, যা সাত থেকে আট ফিট পর্যন্ত লম্বা হয়। নির্বিষ সাপদের মাধ্যে বালুবোয়া, ঘরমৌনী, হেলে ইত্যাদি দেখা যায়, তবে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে জলঢোড়া সাপদের।
নদী ও কিছু জলাধারে দুই ধরনের কুমিরের দেখা মেলে, একটি মাগার কুমির অন্যটি ঘড়িয়াল। মাগার কুমির ১২ ফুটের মত লম্বা হয়, যেখানে মাছখেকো সরু মুখের অধিকারী ঘড়িয়াল হয় আট ফিট। নদীর কচ্ছপ ‘কালি কাইট্ট্যা’ প্রায় সবখানেই মেলে আর নিম্নবর্ণের মানুষেরা সেগুলো খেয়ে থাকে।

আজ এক ‘অগ্নিপুরুষ’-এর জন্মদিন। ইতিহাসের পাতায় যার নাম লেখা আছে ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে, কিন্তু শোষকের কলিজা কাঁপাতে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ দাবানল। তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
৬ ঘণ্টা আগে
সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক না দিলে দিনটা শুরুই হতে চায় না? খালি পেটে চা পান করা ‘স্বাস্থ্যকর’, এই ধারণা অনেকেরই আছে। কিন্তু বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটা মোটেও এত সরল নয়।
৭ ঘণ্টা আগে
১৯৬৭ সালের কথা। খান আতাউর রহমান তখন অভিনেতা, পরিচালক ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত মুখ। ‘অনেক দিনের চেনা’ ও ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’র মতো সিনেমা বানিয়েছেন। সালাহউদ্দিন পরিচালিত ‘সূর্যস্নান’ (১৯৬২) সিনেমায় তৈরি করেছেন ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে’-র মতো গান।
১৯ ঘণ্টা আগে
১৯৭১ সালের রণক্ষেত্র। চারদিকে লুটপাট আর নারী নির্যাতনের মহোৎসব। সাধারণ সৈনিকরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। তাদেরই একজন প্রশ্ন তুলল— ‘আমাদের কমান্ডার (জেনারেল নিয়াজী) নিজেই তো একজন ধর্ষক। তাহলে আমাদের থামাবে কে?’
১ দিন আগে