সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল তর্ক। তবে এই তর্ক এখন আর শুধু একজন লেখককে ঘিরে নয়, এটি বরং হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ের মানুষের মনোভঙ্গী বোঝারও আয়না। কিন্তু কেন?
হুমায়ূন শফিক

বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পর্কে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, ফেসবুকের ইস্যু কী? হুমায়ূন ভক্তরা উত্তরে বলতেই পারেন, হুমায়ূন আহমেদই তো বলে গেছেন ‘থ্রি ডব্লিউ’-এর কথা। হুমায়ূনের তত্ত্বানুসারে এই ‘থ্রি ডব্লিউ’ হচ্ছে—১. উইমেন: মেয়েদের বিষয়ে কিছু বলা সব সময়ই কঠিন। ২. ওয়ার্ক: কাজ বাংলাদেশে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আপনারা তো জানেনই। ৩. ওয়েদার: ঢাকার আবহাওয়া কখন কী হয় বলা মুশকিল।
বাংলাদেশের এই নন্দিত কথাকারের ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’বইটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয় বুঝে গেছেন কোথা থেকে ধার করে ওপরের অংশটুকু লিখলাম। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কখন কী ঘটবে, তা আন্দাজ করা দুঃসাধ্য।

সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল তর্ক। তবে এই তর্ক এখন আর শুধু একজন লেখককে ঘিরে নয়, এটি বরং হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ের মানুষের মনোভঙ্গী বোঝারও আয়না। কেউ বলছেন, প্রাক্তন স্ত্রীর অভিযোগ শোনা উচিত; কেউ বলছেন, মৃত মানুষকে আঘাত করা অন্যায়। আবার কেউ কেউ বিষয়টি নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখছেন। বলছেন, একজন নারীর অভিজ্ঞতা পঞ্চাশ বছর পরেও বলা উচিত। আবার হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে এই তর্ক নিয়ে সাহিত্য-বিশ্লেষকেরা বলছেন, একটি নিছক ব্যক্তিগত ঘটনা। তবে তা এখন পরিণত হয়েছে মানুষের যার যার মতাদর্শের লড়াইয়ে। এখানে হুমায়ূন আহমেদ কেবল প্রতীক, মূল সংঘাত আসলে আমাদের ভেতরের।
৩ অক্টোবর ২০২৫। গুলতেকিন খানের ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় শোরগোল। স্মৃতিকথার মধ্য দিয়ে তাঁদের দাম্পত্য জীবনের কিছু অন্ধকার দিক তুলে ধরেন তিনি। দ্রুত ভাইরাল হয় পোস্টটি।
এ সময় অনেকেই গুলতেকিনের পাশে দাঁড়ান। অনেকে তাঁর বিরুদ্ধে করেন বিষোদগার। কেউ কেউ আবার নিরপেক্ষ দৃষ্টিতেও ঘটনাকে বিশ্লেষণ করেছেন।
বলার কথা হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তর্ককে এখন আর কেউ ‘তথ্য বিনিময়’ হিসেবে দেখেন না। বরং এটি একধরনের ‘পরিচয় যুদ্ধ’, যেখানে আমরা সবাই আমাদের অবস্থান, বিশ্বাস, বা রাজনৈতিক পক্ষ প্রমাণ করতে চাই। হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে যে বিতর্ক উঠেছে, সেখানে যুক্তি নয়, আবেগই বেশি কাজ করছে। কারণ, হুমায়ূন আমাদের অনেকেরই বাল্যকালের নায়ক। কেউ আবারে এখানে পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যের ছাপ খুঁজছেন। ফলে আলোচনা আর নিরপেক্ষ থাকছে কি? এটি কি শেষমেস আমাদের ‘বিশ্বাস’-এর যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে না?

এই পরিস্থিতি অবশ্য নতুন নয়। আমাদের সমাজে যেকোনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব—লেখক, রাজনীতিক বা শিল্পী যে-ই হোন—তাঁকে ঘিরে অধিকাংশ সময়ই আমরা তৈরি করি দুই মেরু। কেউ তাঁকে দেবতা বানিয়ে পূজা করে, কেউ আবার ভেঙে দিতে চায় সেই প্রতিমা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ প্রমুখের নাম। যাঁদের নিয়ে নানা সময়েই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানারকম মতাদর্শের চর্চা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেউ যদি গালি দেন বা তাঁকে নিয়ে কেউ কখনো সমালোচনা করেন, তখন কিন্তু তাঁর ভক্তরা যিনি সমালোচনা করছেন, তাঁকে নানাভাবে হেনস্থার চেষ্টা করেন। হুমায়ূন আহমেদও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই দুই মেরু আসলে তাঁর সাহিত্য বা চিন্তাধারা নিয়ে তর্ক করছে না; বরং তাঁরা নিজেদের চিন্তার জায়গা মজবুত করতে তাঁর নাম ব্যবহার করছে। কেউ নারীবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সমালোচনাকে কাজে লাগাচ্ছে, আবার কেউ ‘আমাদের প্রিয় লেখককে রক্ষা’র নামে গড়ে তুলছেন প্রতিরোধ। অথচ এসব তর্কের কোথাও নেই তাঁর সাহিত্যিক গভীরতা, তাঁর মানসজগতের বিশ্লেষণ বা তাঁর চরিত্রদের প্রতি পাঠকের দায়বোধ।
এছাড়া এই তর্কে সবচেয়ে বড় অনুপস্থিতি হলো সহানুভূতি। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন মানুষ—তাঁর জীবনেও ছিল ভুল, প্রেম, জেদ, দুর্বলতা। অন্যদিকে হুমায়ূনের প্রাক্তন স্ত্রীরও আছে কষ্ট, অভিমান ও অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমরা কোনো দিকই শুনতে চাই না; শুধু চাই আমাদের পক্ষের গল্পটিই জোরে বলতে। ফলে একসময় সব আলোচনা থেমে যায়, রয়ে যায় শুধু বিতর্ক। হুমায়ূন আহমেদের বড় ছেলে নুহাশ হুমায়ূনের পোস্টটি এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আপনি একজন শিল্পী বা সৃষ্টিশীল মানুষকে তাঁর কাজের জন্য ভালোবাসতে পারেন, পাশাপাশি এটা স্বীকার করা দোষের কিছু নয় যে তাঁর ব্যক্তিজীবন ত্রুটিপূর্ণ ছিল। দুই বাস্তবতাই সত্য হতে পারে। আসলে মানুষ জটিল এবং অসম্পূর্ণ (যেমন আপনার প্রিয় উপন্যাসের সেরা চরিত্ররা)। কেউ লাখো মানুষের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসেন, আবার কাছের মানুষদের কষ্ট দেন। সমাধান হলো কষ্ট পাওয়া মানুষদের চুপ করিয়ে দেওয়া নয়। সমাধান হলো মৃতদের অসম্মান করাও নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—যেমন ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), টিকটক ইত্যাদি আসলে এত দিন এভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছে আমাদের। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে কোনটা সত্য ও যুক্তিপূর্ণ তার চেয়ে ‘আমি ঠিক এটি প্রমাণ করাই মূল লক্ষ্য। হুমায়ূনকে নিয়ে বিতর্কে তাই আমরা লেখককে নয়, নিজেদের মতাদর্শকেই রক্ষা করছি বলে মনে হয়। কেননা আমাদের মন্তব্য, শেয়ার, প্রতিক্রিয়া—সবই আসলে নিজেদের ব্যক্তিগত অবস্থান ঘোষণারই নামান্তর।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ‘আমিত্ব’ নিয়ে অনেক বিশ্লেষকই কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম মনোবিদ ডেভিয়া সিলস। তিনি ‘সাইকোলজি টুডে’তে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ে। মানুষ সামাজিক জীব তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা একজন অন্যজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্ট্যাটাস আপডেট এবং প্রতিক্রিয়ার পদ্ধতি আমাদেরকে আত্মমুখী করে তোলে। এটা অনেক সময় আমাদের নেতিবাচকও করে তোলে, অন্যের দোষ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা।
আর এই প্রক্রিয়ায় হয়তো হারিয়ে যায় জরুরি একটি জিনিস, তা হলো—অন্যকে বোঝার চেষ্টা। একজন মানুষ যেমন বহু স্তরবিশিষ্ট, তেমনি কোনো একটি সম্পর্কও কম জটিল নয়। হুমায়ূনের জীবনকে একপাক্ষিক চোখে দেখা মানে তাঁর সাহিত্যকেও একরঙা করে ফেলা। তাঁর জীবনের আলো-অন্ধকার, হাসি-কান্না—সব মিলিয়েই তিনি ছিলেন একজন মানুষ। যাঁকে পুরোপুরি বুঝতে হলে আবেগ নয়, দরকার সংবেদনশীলতা। একই কথা খাটে গুলতেকিন খানের বিষয়েও।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের প্রভাব নিয়ে ২০১৭ সালে মনোবিদ আন্দ্রেয়াসেন ও তাঁর সহকর্মীরা ২৩ হাজার ৫ শ ৩২ জনের ওপর একটি গবেষণায় করেছিলেন। এতে দেখা গেছে, কম আত্মবিশ্বাস এবং আত্মকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে দীর্ঘসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের যোগসূত্র রয়েছে। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতি ব্যাবহারের ফলে আমরা এখন অন্যের সঙ্গে নিজের আবেগ প্রকাশ করতে ভুলে যাই। ‘ভার্চুয়াল ডিসএনগেজমেন্ট’ তত্ত্ব অনুসারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত মিথস্ক্রিয়া সহানুভূতি এবং অন্যের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা হ্রাস করতে পারে।
তাই আমরা যদি সত্যিই হুমায়ূন আহমেদকে ভালোবাসি বা গুলতেকিন খানের প্রতি সহমর্মী হই, তবে হয়তো এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, দুজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে দোষারোপ না করা। বরং হুমায়ূন আহমেদ ও গুলতেকিন খানের সাহিত্য জগত নিয়েই আমরা বেশি বেশি আলোচনা করতে পারি। করতে পারি সমালোচনাও।
আমরা আসলে এই তর্ক শুধু হুমায়ূন বা গুলতেকিনকে নয়, আমাদেরকেই প্রকাশ করছি। কীভাবে আমরা মতামতের নামে অন্যকে আক্রমণ করছি, কেমন সহজে মানুষকে দেবতা বা দানব বানিয়ে ফেলছি—এই ঘটনা যেন তারই জ্বলন্ত উদহারণ।
আমরা কি সত্যিই হুমায়ূন আহমেদ বা গুলতেকিন খান নিয়ে কথা বলছি, নাকি নিজেদের অন্ধবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করছি?
লেখক: কথাসাহিত্যিক; সাংবাদিক

বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সম্পর্কে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, ফেসবুকের ইস্যু কী? হুমায়ূন ভক্তরা উত্তরে বলতেই পারেন, হুমায়ূন আহমেদই তো বলে গেছেন ‘থ্রি ডব্লিউ’-এর কথা। হুমায়ূনের তত্ত্বানুসারে এই ‘থ্রি ডব্লিউ’ হচ্ছে—১. উইমেন: মেয়েদের বিষয়ে কিছু বলা সব সময়ই কঠিন। ২. ওয়ার্ক: কাজ বাংলাদেশে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আপনারা তো জানেনই। ৩. ওয়েদার: ঢাকার আবহাওয়া কখন কী হয় বলা মুশকিল।
বাংলাদেশের এই নন্দিত কথাকারের ‘নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ’বইটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয় বুঝে গেছেন কোথা থেকে ধার করে ওপরের অংশটুকু লিখলাম। বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কখন কী ঘটবে, তা আন্দাজ করা দুঃসাধ্য।

সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল তর্ক। তবে এই তর্ক এখন আর শুধু একজন লেখককে ঘিরে নয়, এটি বরং হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ের মানুষের মনোভঙ্গী বোঝারও আয়না। কেউ বলছেন, প্রাক্তন স্ত্রীর অভিযোগ শোনা উচিত; কেউ বলছেন, মৃত মানুষকে আঘাত করা অন্যায়। আবার কেউ কেউ বিষয়টি নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখছেন। বলছেন, একজন নারীর অভিজ্ঞতা পঞ্চাশ বছর পরেও বলা উচিত। আবার হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে এই তর্ক নিয়ে সাহিত্য-বিশ্লেষকেরা বলছেন, একটি নিছক ব্যক্তিগত ঘটনা। তবে তা এখন পরিণত হয়েছে মানুষের যার যার মতাদর্শের লড়াইয়ে। এখানে হুমায়ূন আহমেদ কেবল প্রতীক, মূল সংঘাত আসলে আমাদের ভেতরের।
৩ অক্টোবর ২০২৫। গুলতেকিন খানের ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় শোরগোল। স্মৃতিকথার মধ্য দিয়ে তাঁদের দাম্পত্য জীবনের কিছু অন্ধকার দিক তুলে ধরেন তিনি। দ্রুত ভাইরাল হয় পোস্টটি।
এ সময় অনেকেই গুলতেকিনের পাশে দাঁড়ান। অনেকে তাঁর বিরুদ্ধে করেন বিষোদগার। কেউ কেউ আবার নিরপেক্ষ দৃষ্টিতেও ঘটনাকে বিশ্লেষণ করেছেন।
বলার কথা হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তর্ককে এখন আর কেউ ‘তথ্য বিনিময়’ হিসেবে দেখেন না। বরং এটি একধরনের ‘পরিচয় যুদ্ধ’, যেখানে আমরা সবাই আমাদের অবস্থান, বিশ্বাস, বা রাজনৈতিক পক্ষ প্রমাণ করতে চাই। হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে যে বিতর্ক উঠেছে, সেখানে যুক্তি নয়, আবেগই বেশি কাজ করছে। কারণ, হুমায়ূন আমাদের অনেকেরই বাল্যকালের নায়ক। কেউ আবারে এখানে পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যের ছাপ খুঁজছেন। ফলে আলোচনা আর নিরপেক্ষ থাকছে কি? এটি কি শেষমেস আমাদের ‘বিশ্বাস’-এর যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে না?

এই পরিস্থিতি অবশ্য নতুন নয়। আমাদের সমাজে যেকোনো জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব—লেখক, রাজনীতিক বা শিল্পী যে-ই হোন—তাঁকে ঘিরে অধিকাংশ সময়ই আমরা তৈরি করি দুই মেরু। কেউ তাঁকে দেবতা বানিয়ে পূজা করে, কেউ আবার ভেঙে দিতে চায় সেই প্রতিমা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ প্রমুখের নাম। যাঁদের নিয়ে নানা সময়েই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানারকম মতাদর্শের চর্চা দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেউ যদি গালি দেন বা তাঁকে নিয়ে কেউ কখনো সমালোচনা করেন, তখন কিন্তু তাঁর ভক্তরা যিনি সমালোচনা করছেন, তাঁকে নানাভাবে হেনস্থার চেষ্টা করেন। হুমায়ূন আহমেদও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই দুই মেরু আসলে তাঁর সাহিত্য বা চিন্তাধারা নিয়ে তর্ক করছে না; বরং তাঁরা নিজেদের চিন্তার জায়গা মজবুত করতে তাঁর নাম ব্যবহার করছে। কেউ নারীবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সমালোচনাকে কাজে লাগাচ্ছে, আবার কেউ ‘আমাদের প্রিয় লেখককে রক্ষা’র নামে গড়ে তুলছেন প্রতিরোধ। অথচ এসব তর্কের কোথাও নেই তাঁর সাহিত্যিক গভীরতা, তাঁর মানসজগতের বিশ্লেষণ বা তাঁর চরিত্রদের প্রতি পাঠকের দায়বোধ।
এছাড়া এই তর্কে সবচেয়ে বড় অনুপস্থিতি হলো সহানুভূতি। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন মানুষ—তাঁর জীবনেও ছিল ভুল, প্রেম, জেদ, দুর্বলতা। অন্যদিকে হুমায়ূনের প্রাক্তন স্ত্রীরও আছে কষ্ট, অভিমান ও অভিজ্ঞতা। কিন্তু আমরা কোনো দিকই শুনতে চাই না; শুধু চাই আমাদের পক্ষের গল্পটিই জোরে বলতে। ফলে একসময় সব আলোচনা থেমে যায়, রয়ে যায় শুধু বিতর্ক। হুমায়ূন আহমেদের বড় ছেলে নুহাশ হুমায়ূনের পোস্টটি এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আপনি একজন শিল্পী বা সৃষ্টিশীল মানুষকে তাঁর কাজের জন্য ভালোবাসতে পারেন, পাশাপাশি এটা স্বীকার করা দোষের কিছু নয় যে তাঁর ব্যক্তিজীবন ত্রুটিপূর্ণ ছিল। দুই বাস্তবতাই সত্য হতে পারে। আসলে মানুষ জটিল এবং অসম্পূর্ণ (যেমন আপনার প্রিয় উপন্যাসের সেরা চরিত্ররা)। কেউ লাখো মানুষের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসেন, আবার কাছের মানুষদের কষ্ট দেন। সমাধান হলো কষ্ট পাওয়া মানুষদের চুপ করিয়ে দেওয়া নয়। সমাধান হলো মৃতদের অসম্মান করাও নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—যেমন ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), টিকটক ইত্যাদি আসলে এত দিন এভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছে আমাদের। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে কোনটা সত্য ও যুক্তিপূর্ণ তার চেয়ে ‘আমি ঠিক এটি প্রমাণ করাই মূল লক্ষ্য। হুমায়ূনকে নিয়ে বিতর্কে তাই আমরা লেখককে নয়, নিজেদের মতাদর্শকেই রক্ষা করছি বলে মনে হয়। কেননা আমাদের মন্তব্য, শেয়ার, প্রতিক্রিয়া—সবই আসলে নিজেদের ব্যক্তিগত অবস্থান ঘোষণারই নামান্তর।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ‘আমিত্ব’ নিয়ে অনেক বিশ্লেষকই কথা বলেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম মনোবিদ ডেভিয়া সিলস। তিনি ‘সাইকোলজি টুডে’তে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ে। মানুষ সামাজিক জীব তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা একজন অন্যজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের স্ট্যাটাস আপডেট এবং প্রতিক্রিয়ার পদ্ধতি আমাদেরকে আত্মমুখী করে তোলে। এটা অনেক সময় আমাদের নেতিবাচকও করে তোলে, অন্যের দোষ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা।
আর এই প্রক্রিয়ায় হয়তো হারিয়ে যায় জরুরি একটি জিনিস, তা হলো—অন্যকে বোঝার চেষ্টা। একজন মানুষ যেমন বহু স্তরবিশিষ্ট, তেমনি কোনো একটি সম্পর্কও কম জটিল নয়। হুমায়ূনের জীবনকে একপাক্ষিক চোখে দেখা মানে তাঁর সাহিত্যকেও একরঙা করে ফেলা। তাঁর জীবনের আলো-অন্ধকার, হাসি-কান্না—সব মিলিয়েই তিনি ছিলেন একজন মানুষ। যাঁকে পুরোপুরি বুঝতে হলে আবেগ নয়, দরকার সংবেদনশীলতা। একই কথা খাটে গুলতেকিন খানের বিষয়েও।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের প্রভাব নিয়ে ২০১৭ সালে মনোবিদ আন্দ্রেয়াসেন ও তাঁর সহকর্মীরা ২৩ হাজার ৫ শ ৩২ জনের ওপর একটি গবেষণায় করেছিলেন। এতে দেখা গেছে, কম আত্মবিশ্বাস এবং আত্মকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে দীর্ঘসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের যোগসূত্র রয়েছে। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতি ব্যাবহারের ফলে আমরা এখন অন্যের সঙ্গে নিজের আবেগ প্রকাশ করতে ভুলে যাই। ‘ভার্চুয়াল ডিসএনগেজমেন্ট’ তত্ত্ব অনুসারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত মিথস্ক্রিয়া সহানুভূতি এবং অন্যের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা হ্রাস করতে পারে।
তাই আমরা যদি সত্যিই হুমায়ূন আহমেদকে ভালোবাসি বা গুলতেকিন খানের প্রতি সহমর্মী হই, তবে হয়তো এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, দুজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে দোষারোপ না করা। বরং হুমায়ূন আহমেদ ও গুলতেকিন খানের সাহিত্য জগত নিয়েই আমরা বেশি বেশি আলোচনা করতে পারি। করতে পারি সমালোচনাও।
আমরা আসলে এই তর্ক শুধু হুমায়ূন বা গুলতেকিনকে নয়, আমাদেরকেই প্রকাশ করছি। কীভাবে আমরা মতামতের নামে অন্যকে আক্রমণ করছি, কেমন সহজে মানুষকে দেবতা বা দানব বানিয়ে ফেলছি—এই ঘটনা যেন তারই জ্বলন্ত উদহারণ।
আমরা কি সত্যিই হুমায়ূন আহমেদ বা গুলতেকিন খান নিয়ে কথা বলছি, নাকি নিজেদের অন্ধবিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করছি?
লেখক: কথাসাহিত্যিক; সাংবাদিক

২০০৭ সালের ‘ওয়ান-ইলেভেন’ থেকে ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং তৎপরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কাল পর্যন্ত বাংলাদেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রার একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ এই লেখা। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের অভাব, আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতার সংকট এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে সৃষ্ট সামাজিক ক্ষত ত
৪ ঘণ্টা আগে
ঢাকার ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গত ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভিন্ন আবহে পালিত হয় ৫৪তম মৈত্রী দিবস। এতে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে স্থিতিশীল, ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক চায়।
১ দিন আগেবাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত বার্ষিক ডেভেলপমেন্ট কনফারেন্সের এবারের আলোচনার শিরোনাম ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন’, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। আমরা সবাই এখন এই বিষয়টি নিয়েই ভাবছি।
১ দিন আগে
পেরুর বিচারক লুজ দেল কারমেন ইবানিয়েজ কারাঞ্জর ওপর গত জুনে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। কারণ, তিনি ২০০৩ সালের পর আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের অপরাধ তদন্তের অনুমতি দিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে গত এক বছরে ছয়জন আইসিসি বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
১ দিন আগে