leadT1ad

রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বাংলাদেশি নারী দলের হিমালয় অভিযানের অনুপ্রেরণা

মাসউদ ইমরান মান্নু
মাসউদ ইমরান মান্নু

‘সুলতানাস ড্রিম আনবাউন্ড’ শিরোনামে পাঁচ সদস্যের সর্ব-নারী দল হিমালয়ে একটি ঐতিহাসিক শীতকালীন অভিযানের সূচনা করেন। সংগৃহীত ছবি

প্রতিদিনকার লড়াইয়ে নারীদের অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ১৯০৫ সালে ‘দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত সুলতানা’স ড্রিম আজকের নারীর জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। হিমালয় জয় করবার বাসনায় নারীদের মনে শক্তির সঞ্চার করছে।

কেবল নারী মুক্তির জায়গা থেকেই নয় নারীর মনে বিজ্ঞানের যৌক্তিক ধারণারও জন্ম দিচ্ছেন রোকেয়া। সুলতানার স্বপ্ন একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকথা হিসেবেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এখানে হেলিকপ্টার ও সোলার শক্তির ধারণার বিষয়গুলোও উল্লেখিত হয়েছে। এই অসাধারণ ইউটোপিয়ান সাই-ফাই নারীবাদী সাহিত্যিক মাস্টারপিসটি হিমালয়ে সর্ব-নারী অভিযানকে দারুণভাবে প্রেরণা জোগানোয় ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর আঞ্চলিক রেজিস্টারে ২০২৪ সালের মে মাসে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই সর্ব-নারী অভিযানটি আয়োজন করেছিল অভিযাত্রী নিশাত মজুমদারের প্রতিষ্ঠিত একটি বাংলাদেশি পর্বতারোহণ সংস্থা, যা লিঙ্গ সমতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে উৎসাহিত করে। এটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ইউনেস্কো দ্বারা অনুমোদিত ছিল এবং এ অভিযানের ব‍্যয়ভার গ্রহণ করেছিল মাস্টারকার্ড।

১৯৯৮ সালে চালু হওয়ার পর থেকে, ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড কমিটি ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক ২৭টি দেশের ৮৪টি প্রামাণ্য উপাদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে, লিঙ্গভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ঐতিহাসিক ভারসাম্যহীনতা দূর করতে ২০২০ সাল থেকে মনোনয়নের জন্য লিঙ্গ সমতাকে একটি সুস্পষ্ট বিবেচনা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সুলতানার স্বপ্ন পিতৃতন্ত্র ও তৎকালীন সমাজের রক্ষণশীল নিয়মগুলো নিয়ে একটি সাহসী ব্যঙ্গাত্মক রচনা। গল্পটি একটি ইউটোপীয় মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কল্পনা করে। সেখানে নারীরা নেতৃত্ব দেয়। পুরুষরা ধূমপান করে সময় নষ্ট করত বলে কাজের সময় কমিয়ে দুই ঘণ্টা করা হয়। ইউনেস্কোর এশিয়া-প্যাসিফিকের মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারের সেক্রেটারি-জেনারেল লিন আন মোরো এই কাজটিকে ‘জেন্ডার ট্রান্সফরমেটিভ হেরিটেজ’ বা ‘লিঙ্গ রূপান্তরকারি ঐতিহ্য’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করবেন বলে জানান। কারণ এটি ‘একজন নারী দ্বারা রচিত, নারীদের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ এবং নারীদের অবস্থার প্রতিফলন ঘটায়।’ এই কালজয়ী সাহিত্যকর্মটি কেবল একটি নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনী হিসেবেই নয়, বরং এটি বাস্তব জীবনে নারীর ক্ষমতায়ন এবং দুঃসাহসিকতাকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রেও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

রোকেয়া সম্ভবত নিজেও এতটা দূর ভেবেছিলেন কিনা, তা ধারণা করার অবকাশ নেই। তবে এক শতাব্দীরও বেশি সময় পরে তাঁর কাজটি বাংলাদেশ থেকে নেপালের হিমালয়ের লাংটাং অঞ্চলে প্রথম নারীদের শীতকালীন অভিযানের প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। হিমালয় অভিযাত্রার শেষে নেপালের কাঠমান্ডুতে গত বছর ১৪ জানুয়ারি বাংলাদেশি পাঁচ নারী পর্বতারোহীর পক্ষ থেকে ইয়াসমিন লিসা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘রোকেয়া সাখাওয়াতের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। এই অভিযানের মাধ্যমে আমার স্বপ্নগুলো সীমাহীন হয়েছে, বিশেষ করে এমন সমাজে যেখানে নারীদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ খুব কম।’

ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্য মানবজাতির সম্মিলিত স্মৃতি ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান প্রামাণ্য ঐতিহ্যকে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ এবং সকলের জন্য সহজলভ্য করা।

তাঁর বক্তব্যে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, ‘সুলতানার স্বপ্ন’ তাদের অভিযাত্রার অনুপ্রেরণার উৎস। রোকেয়া তাঁর উপন্যাসে এমন একটি ইউটোপীয় ‘নারীস্থান’ কল্পনা করেছিলেন, যেখানে নারীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে সমাজ পরিচালনা করে। পুরুষরা সেখানে পর্দার আড়ালে থাকে। এই দূরদর্শী গল্পটি লিঙ্গভিত্তিক বাধা অতিক্রম করার এবং নারীর মেধা ও সম্ভাবনাকে মুক্ত করার বার্তা দেয়।

ইউনেস্কোর মেমরি অব দ‍্যা ওয়ার্ল্ড-এর লক্ষ‍্য

ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্য মানবজাতির সম্মিলিত স্মৃতি ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান প্রামাণ্য ঐতিহ্যকে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ এবং সকলের জন্য সহজলভ্য করা।

এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী হলো:

সংরক্ষণ: যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ইচ্ছাকৃত ধ্বংস, বা সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক ক্ষয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নথি, পাণ্ডুলিপি ও আর্কাইভগুলোকে রক্ষা করা।

সহজলভ্যতা: এই ঐতিহ্যগুলোকে ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তর করে ইন্টারনেট ও অন্যান্য মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গবেষক ও সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করা, যাতে ভৌগোলিক বাধা দূর হয়।

সচেচেতনতা বৃদ্ধি: প্রামাণ্য ঐতিহ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং এর সুরক্ষার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতি গ্রহণে উৎসাহিত করা।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: সংরক্ষণ প্রযুক্তি ও দক্ষতার আদান-প্রদানের মাধ্যমে দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

মূলত, এই কার্যক্রম নিশ্চিত করতে চায় যে মানব সভ্যতার লিখিত ইতিহাস ও স্মৃতি বিলুপ্ত হবে না, বরং তা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুরক্ষিত থাকবে।

অভিযান: ‘সুলতানার স্বপ্ন অবারিত’

এই উপন্যাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, বাংলাদেশের পাঁচজন নারী পর্বতারোহী— এভারেস্ট জয়ী প্রথম বাংলাদেশি নারী নিশাত মজুমদার (দলনেতা), ইয়াসমিন লিসা, অর্পিতা দেবনাথ, মৌসুমী আক্তার এপি ও তহুরা সুলতানা রেখা—হিমালয়ে একটি ঐতিহাসিক সর্ব-নারী শীতকালীন অভিযানের সূচনা করেন। তাঁদের অভিযানের স্লোগান ছিল ‘সুলতানার স্বপ্ন অবারিত’ (সুলতানাস ড্রিম আনবাউন্ড)।

এই অভিযানটি ছিল মূলত রোকেয়ার সাহসী দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা। যেমনটি পর্বতারোহী ইয়াসমিন লিসা বলেছেন, রোকেয়ার শিক্ষা তাঁকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে এবং এই অভিযানের মাধ্যমে তাঁর স্বপ্নগুলো ‘সীমাহীন’ হয়েছে।

প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কিছু চূড়া আরোহণের পরিকল্পনা বাতিল হলেও, দলটি ইয়ালা পিক, সূর্য পিক এবং গোসাইকুন্ড পিক সফলভাবে জয় করে। এই পাঁচ নারী ইয়ালা পিক (৫,৫০০ মিটার), ব্যাডেন পাওয়েল পিক (৫,৮৫৭ মিটার) এবং নয়া কাঙ্গা (৫,৮৪৪ মিটার) আরোহণের লক্ষ্য নিয়ে গত বছর ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে যাত্রা শুরু করেন।

ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড আঞ্চলিক রেজিস্টারে বেগম রোকেয়ার উপন্যাসটি অন্তর্ভুক্তির পর হিমালয়ের ইয়ালা, সূর্য এবং গোসাইকুন্ড চূড়ায় পাঁচ নারীর কষ্টসাধ্য যাত্রা প্রমাণ করে যে অতীতে বপন করা মুক্তির বীজ বর্তমানে কীভাবে বিকশিত হতে পারে। পর্বতারোহীদের সাহস ও অধ্যবসায় রোকেয়ার প্রতিধ্বনি, যিনি তাঁর যুগের লিঙ্গ সীমাবদ্ধতাকে সাহসী ধারণা ও অটল সংকল্প দিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

ইউনেস্কোর লিন আন মোরো বলেন, ‘(রোকেয়া সাখাওয়াত) হোসেনের লেখা বিশ্বজুড়ে সৃজনশীল কাজকে অনুপ্রাণিত করেছে, যা তাঁর কল্পনা ও সৃজনশীলতার বৈশ্বিক প্রভাবকে প্রদর্শিত করে। এই অভিযান প্রমাণ করে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ লিঙ্গ সমতার জন্য সমসাময়িক আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। যে সমস্ত নারী ও মেয়ের স্বপ্ন আছে, তারা যেন তাদের স্বপ্নকে ধরে রাখে, কারণ এই স্বপ্ন তাদের কতদূর নিয়ে যেতে পারে তা তারা জানে না।’

সাফল্য ও প্রভাব

প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কিছু চূড়া আরোহণের পরিকল্পনা বাতিল হলেও, দলটি ইয়ালা পিক, সূর্য পিক এবং গোসাইকুন্ড পিক সফলভাবে জয় করে। এই পাঁচ নারী ইয়ালা পিক (৫,৫০০ মিটার), ব্যাডেন পাওয়েল পিক (৫,৮৫৭ মিটার) এবং নয়া কাঙ্গা (৫,৮৪৪ মিটার) আরোহণের লক্ষ্য নিয়ে গত বছর ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে যাত্রা শুরু করেন। তবে, বিপজ্জনক শীতকালীন পরিস্থিতির কারণে দলটি ব্যাডেন পাওয়েল এবং নয়া কাঙ্গা চূড়ায় আরোহণের পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তবু তাঁরা পুনরায় দলবদ্ধ হন এবং সফলভাবে ইয়ালা পিক, সূর্য পিক (৫,১৪৫ মিটার), এবং গোসাইকুন্ড পিক (৪,৩৮০ মিটার) জয় করেন, যা প্রতিকূলতার মুখে তাঁদের স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন ক্ষমতাকে তুলে ধরে।

এই অভিযানটি কেবল শারীরিক সাহসিকতার প্রদর্শনী ছিল না। এটি ছিল নারীদের স্বপ্ন দেখাকে সীমিত করে দেওয়া সমাজের প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জবাব। ইউনেস্কোর প্রতিনিধি লিন আন মোরো এই কাজটিকে ‘লিঙ্গ পরিবর্তনকারী ঐতিহ্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

অভিযানটি শেষ হওয়ার পরেও এর প্রভাব চলমান রয়েছে। সুলতানার স্বপ্ন–এর একটি নেপালি অনুবাদ প্রকাশের পরিকল্পনা করা হয়েছে। নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে এই সর্ব-নারী অভিযানকে একটি বার্ষিক ইভেন্ট হিসেবে চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এইভাবে, এক শতাব্দীর পুরোনো একটি সাহিত্যকর্ম প্রমাণ করেছে যে, মুক্তির বীজ সময়ের ব্যবধান পেরিয়ে বর্তমান প্রজন্মের নারীদেরকে তাঁদের নিজেদের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যেতে এবং স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে। দলনেতা নিশাত মজুমদার বলেন, “অনেক মেয়ে আমাদের বলছে—আমিও এখানে থাকতে পারতাম, আমিও একজন সুলতানা হতে পারতাম।” এই বার্তাটিই আমাদের সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।’

Ad 300x250
সর্বাধিক পঠিত

সম্পর্কিত