leadT1ad

নির্বাচনী জরিপে বিএনপির এগিয়ে থাকা কী ইঙ্গিত দিচ্ছে

ড. মো. শামছুল আলম
ড. মো. শামছুল আলম

স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ততই বাড়ছে উত্তাপ। চারিদিকে চলছে নানা জল্পনা–কল্পনা ও বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত সবখানে এখন নির্বাচনী আলাপ। নির্বাচন ঘিরে যথারীতি চলছে বিভিন্ন জনমত জরিপ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার জরিপের ফলাফলে কিছুটা ভিন্নতা দেখা গেলেও সকল ক্ষেত্রে একটি সাধারণ বিষয় চোখে পড়ার মতো। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সাম্প্রতিক যেসব নির্বাচনী জরিপ প্রকাশিত হয়েছে তার অধিকাংশতেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ব্যাপক ভোটে এগিয়ে আছে। এসব ফলাফল নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক আলাপচারিতাকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে। নির্বাচনী জরিপে উদ্ভাসিত জনমতের গতিপ্রকৃতি বা বিএনপির দিকে জনগণের আস্থা ইত্যাদি বিষয় এখন জনমনে ব্যাপক মাত্রায় ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই অগ্রগতি আসলে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? বস্তুত, জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে আসন্ন নির্বাচনে জনমতের ঢেউ কার দিকে যেতে চলেছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। জনমতের এ প্রবণতা বাংলাদেশের ভোটার আচরণ ও গণতান্ত্রিক প্রত্যাশার আলোকে ব্যাখ্যা করলে তা আরও স্পষ্ট হবে।

গত ০৯ ডিসেম্বর প্রথম আলো “বিএনপি নির্বাচনে বেশি আসন জিতবে, মত ৬৬% মানুষের” শিরোনামে একটি জরিপভিত্তিক সংবাদ প্রকাশ করে। প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে জাতীয় জনমত জরিপ ২০২৫’ জরিপটি করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিমেকারস কনসাল্টিং লিমিটেড। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, প্রায় ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভ করবে বিএনপি। নারী, পুরুষ, নানা বয়স শ্রেণিভেদে প্রায় সবারই কাছাকাছি মত এসেছে। অপরদিকে, ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ মনে করেন নির্বাচনে বেশি আসন পাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর আগে, ইনোভিশন কনসাল্টিং ফার্ম কর্তৃক পরিচালিত ‘জনগণের নির্বাচন ভাবনা’ শীর্ষক জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে বিএনপি। দলটির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটার। এর পরেই রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, যাদের প্রতি ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটারের সমর্থন দেখা গেছে।

সন্দেহাতীতভাবেই নির্বাচনী জরিপে বিএনপির এমন অগ্রগতির বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। জরিপে বিএনপির অগ্রগতি শুধুমাত্র দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ইঙ্গিতই নয়; বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা জনমতেরই প্রতিফলন। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছে। নির্বাচন ও শাসন প্রক্রিয়া নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। জনগণ যথার্থই বুঝতে শুরু করেছে, এসব থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায় হলো বিএনপির ক্ষমতায়ন। আবার, স্বাভাবিকভাবেই যখন নাগরিকরা মনে করেন অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব বা সামাজিক বৈষম্য তীব্রভাবে বেড়েছে, তখন তাঁরা ইতিহাসের দিকে সফল নেতৃত্ব খুঁজতে থাকেন। বর্তমান সংকটপূর্ণ প্রেক্ষাপটে জনগণের এই মনস্তাত্ত্বিক কারণটি আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। কারণ, বিএনপির অতীত ইতিহাস ঘাটলে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ইতিহাসই সামনে আসে। তাই জনগণ স্বভাবতই বিএনপির উপর আস্থা রাখতে চাইছে।

জরিপে বিএনপির শক্তিশালী অবস্থান সম্পর্কে নানা মত রয়েছে। তবে, এটি সচেতন নাগরিক সমাজের পাশাপাশি তরুণ ভোটারদের ভূমিকার প্রতিফলন হতে পারে বলে অনেকের বিশ্বাস। বর্তমানে বাংলাদেশের ভোটারদের একটি বড় অংশই তরুণ। তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে সীমিত হলেও প্রত্যাশা বেশ উচ্চ। তাঁরা অধিকতর গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ চায়, যা তাদেরকে বিএনপির প্রতি আস্থাশীল করে তুলছে। বিশেষত, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে বিএনপি সবসময়ই এগিয়ে। আবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান দেশের একটি বৃহৎ অংশের তরুণদের কাছে ভরসার নাম। তাঁর উপর বহু তরুণ আস্থাশীল বলেই মনে হয়। বিগত কয়েক বছরে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নগ্ন হস্তক্ষেপ ও সীমান্ত হত্যার মতো উদ্বেগজন ঘটনায় দেশের তরুণ সমাজ ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ। এমন বাস্তবতায় দেশের আগামীর রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তারেক রহমান এক প্রকার আশার বাতিঘর হয়ে আছেন।

স্বভাবতই জরিপ কখনোই চূড়ান্ত সত্য নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, এটি হলো স্ন্যাপশট অব দ্য মোমেন্ট। অর্থাৎ, এটি কোনো সময়ের মুহূর্তগত বাস্তবতার চিত্র। নির্বাচনী মাঠের গতিশীলতা, প্রচার–কৌশল, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, প্রতীকী ঘটনা, এমনকি শেষ সময়ের বোঝাপড়া সবকিছুই ভোটারদের মতামতকে বদলে দিতে পারে।

বলা বাহুল্য, শুধু বর্তমান প্রেক্ষাপটই নয়, বরং বিএনপির প্রতি জনগণের আস্থা সবসময়ই দৃঢ় ছিল। আর সাম্প্রতিক জরিপে সেই আস্থারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্ব, উনিশ দফা কর্মসূচি, সার্ক প্রতিষ্ঠার ধারণা, কৃষি উন্নয়ন ও প্রবাসী শ্রমবাজার উন্মোচন ইত্যাদি বাংলাদেশের আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের মৌলিক ভিত্তি তৈরি করেছে, যা আজও জনগণকে বিএনপির প্রতি আকৃষ্ট করে। জিয়াউর রহমান যেই উদার, অংশগ্রহণমূলক ও বিকেন্দ্রীকরণভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শনের সূচনা করেছিলেন, তা আজও দলটির রাজনৈতিক পরিচয়ের কেন্দ্রে রয়েছে। একইভাবে আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম, রাজনৈতিক চাপের মুখেও তাঁর দৃঢ়তা এবং জনগণের প্রতি নিঃশর্ত দায়বদ্ধতা তাঁকে জাতীয় নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গৃহবন্দী থাকা সত্ত্বেও তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান বদলাননি বরং তাঁর দৃঢ় অবস্থান জনগণের আস্থাকে আরও গভীর করেছে। আবার বর্তমানে সংবিধান ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা নিয়ে কাজ করছে বিএনপি। ফলে দেশের বৃহৎ একটি অংশ এখনও বিশ্বাস করে গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে বিএনপির বিকল্প একমাত্র বিএনপিই। এই আস্থাই আগামী নির্বাচনে তাদের পক্ষে অনুকূল ফলাফলের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে বিশ্লেকদের ধারণা।

একটি বিষয় বলে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি খুবই সংকীর্ণ। এখানকার নাগরিকেরা রাজনৈতিক বিষয়ে খুব একটা সচেতন নয়। হাতে গোনা কয়েক শতাংশ মানুষ সচেতনভাবে রাজনীতিতে অংশ নেন এবং ভেবেচিন্তে ভোট প্রদান করেন। চলতি বছরের আগস্টে প্রকাশিত ‘ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)’-এর নির্বাচনী জরিপ দেখলেই তা স্পষ্ট হবে। জরিপে দেখা যায়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি প্রায় সাড়ে ৪৮ শতাংশ ভোটার। বর্তমানে সংখ্যাটি কম-বেশি হতে পারে। তবে নির্বাচনের সময়েও এমন বড় একটি সংখ্যা থাকবে যাদের রাজনৈতিক আদর্শ কিংবা আগ্রহ কম। অর্থাৎ, দেশের বড় একটি অংশ সুইং ভোটার। তাই বিএনপির ইতিহাস ও নেতৃত্বগুণকে বর্তমান প্রজন্মের সামনে নতুনভাবে উপস্থাপন করাই এখন সময়ের দাবি। এজন্য বিএনপিকে আগের চেয়ে আরও বেশি দলীয় আদর্শকে যুগোপযোগী রূপ দেওয়া, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, যুবসমাজের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা বোঝা এবং সুনির্দিষ্ট জনকল্যাণ পরিকল্পনা উপস্থাপন করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অগ্রাহ্য করা যায় না। স্বভাবতই জরিপ কখনোই চূড়ান্ত সত্য নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, এটি হলো স্ন্যাপশট অব দ্য মোমেন্ট। অর্থাৎ, এটি কোনো সময়ের মুহূর্তগত বাস্তবতার চিত্র। নির্বাচনী মাঠের গতিশীলতা, প্রচার–কৌশল, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, প্রতীকী ঘটনা, এমনকি শেষ সময়ের বোঝাপড়া সবকিছুই ভোটারদের মতামতকে বদলে দিতে পারে। তাই জরিপের ওপর ভিত্তি করে আগাম কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বাস্তবসম্মত নয়। বরং এগুলোকে একটি প্রবণতা বা অন্তর্নিহিত মনোভাব বোঝার সূত্র হিসেবে দেখতে হবে। তাই জরিপের উপর ভিত্তি করে নেতাকর্মীদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। বরং এ মুহূর্তে তাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে কীভাবে বাস্তব জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড, সুশাসনের প্রতিশ্রুতি ও জনগণের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে ভোটারদের আস্থা আরও গভীর করা যায় সেদিকে। এজন্য এই মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো ব্যাপকমাত্রায় জনসংযোগ। এখন বিএনপির লক্ষ্য ও দায়িত্ব হলো জন-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবসম্মত, শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক পথে পরিচালনা করা।

ড. মো: শামছুল আলম: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন

Ad 300x250

সম্পর্কিত