leadT1ad

‘ছ্যাকা খাওয়া’ যে ৮টা গান শুনলেই বুকে লাগে চিনচিনে ব্যাথা

‘গভীরতম দুঃখের গল্প বলা গানগুলো আমাদের মধুরতম গান– লিখেছিলেন পি বি শেলি। দুঃখের গানের নানা ধরণের মধ্যে আছে এক বিশেষ ধরণ। একে চলতি বাংলায় বলে ‘ছ্যাকা খাওয়া’ গান। করুণরসের তেমনই আলোচিত কিছু গান নিয়ে এই লেখা। দেখুন তো গানগুলো শুনলে আপনারও বুকে চিনচিনে ব্যথা হয় কিনা।

তাহমীদ চৌধুরী
তাহমীদ চৌধুরী

প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রেম ব্যাপারটা গোলমালের তা আমরা জানি। অভিজ্ঞতা বলে, প্রেমে পড়াটা সহজ। ধপ করে পড়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা বাঁধে, যখন সেই প্রেম ‘নাই’ হয়ে যায়। তখন শুরু হয় বুকের ভেতর উথালপাথাল। চিকিৎসাশাস্ত্রে এর কোনো নাম আছে কিনা জানা নাই। তবে সাহিত্যিকেরা হৃদয়বিদারক এই অবস্থার নাম দিয়েছেন ‘হৃদয়ভঙ্গ’। খাশ বাংলায় যাকে বলে ‘ছ্যাকা খাওয়া’।

ছ্যাকা খাওয়ার পর বদলে যায় পৃথিবীর রঙ। পূর্ণিমার চাঁদকে মনে হয় পোড়া পাঁপড়। রিক্সার হর্নকে মনে হয় ওসমান হাদীর বক্তৃতা। হৃদয়বিদারক এই সময়ে একমাত্র ওষুধ সম্ভবত গান। যেসব গান শুনলে মনে হবে অনন্ত জলিলের মত কলিজাটা কেউ শক্ত হাতে চিপে ধরেছে। এই ধরাধরির জরুরত আছে। কেননা হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, (বলে থাকারই কথা) অদ্ভুত মানুষের মন। সে কষ্ট পেতে ভালোবাসে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো সে বিরহী সুর দিয়েই খুঁজে পেতে চায় আনন্দঘন নির্মল বিকেল।

এই লেখা বাংলাদেশের ‘ছ্যাকা খাওয়া’ গানের একটা ছোটখাটো প্লেলিস্ট মত। আলোচিত ছ্যাকা-খাওয়া কিছু গান নিয়ে এখানে হালকা চালে আলাপের চেষ্টা করবো।

১. প্রেমের সমাধি ভেঙ্গে | এন্ড্রু কিশোর
বাংলার ব্যর্থ প্রেমিক সমাজের মুকুটহীন সম্রাট হলেন বাপ্পারাজ। উনার মুখের দিকে তাকালেই মায়া লাগে; মনে হয় ‘আহারে, বেচারা’। সিনেমায় বাপ্পারাজ প্রেম করবেন ঠিক আছে; কিন্তু সেই প্রেম টিকবে না, এটাও নিশ্চিত। নায়িকা শেষমেশ বড়লোক বাবার পছন্দের ছেলের হাত ধরে চলে যাবে। আর আমাদের বাপ্পারাজ ভাই দূর থেকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকবেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজবে এই গান। গলাটা এন্ড্রু কিশোরের কিন্তু কষ্টটা বাপ্পারাজের। নব্বই দশকের বহু ‘ছ্যাকাখোরের’ হাহাকার এই গানে মিশে আছে। গানটার কথাগুলো খেয়াল করুন। ‘প্রেমের সমাধি ভেঙ্গে/মনের শিকল ছিঁড়ে/পাখি যায় উড়ে যায়’। সমাধি সাধারণত মাটিতে হয়। সিমেন্ট-বালু দিয়ে বাঁধানো হয়। কিন্তু মনের ভেতর যে সমাধি তৈয়ার হয় সেটা দেখা যায় না। অথচ তার ভার অনেক বেশি। গানটা শুনলে মনে হয়, প্রেম করে বাপ্পারাজ কোনো অপরাধ করেননি। অপরাধ করেছে পৃথিবী; যে পৃথিবীতে ভালোবাসার কোনো দাম নেই।

২. ও প্রিয়া তুমি কোথায় | আসিফ
সালটা ২০০১। হুট করে সারা বাংলাদেশ প্রশ্ন করতে শুরু করল। ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়?’ পাড়ার মোড়, চায়ের দোকান, বাসের ছাদ, এমনকি বিয়ে বাড়ি— সবখানে একই গান। আসিফ আকবর নামের এক যুবক এসে পুরো দেশ মাতিয়ে দিলেন। গানে তিনি প্রিয়াকে খুঁজছেন। হন্যে হয়ে খুঁজছেন। প্রিয়া কোথায় আছে কেউ জানে না। সে কি হারিয়ে গেছে? নাকি লুকিয়ে আছে? গায়ক জানেন না।

প্রেমে পড়লে মানুষ একটু-আধটু পাগল হয়। আর প্রেমিকা হারিয়ে গেলে পুরোপুরি পাগল হয়। আসিফের গায়কী ছিল একেবারে বিধ্বংসী। তিনি যখন ‘ও প্রিয়া’ বলে টান দেন, তখন মনে হয় বুকের ভেতর থেকে সব বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রেমিকেরা এই গান শুনে নিজেদের সান্ত্বনা খোঁজে। তারা ভাবে, আসিফ ভাইও প্রিয়াকে পাননি, আমি আর কোন ‘স্যার’। দুঃখ ভাগ করে নিলে কমে। এই গান সেই কাজটাই করে। ব্যর্থ প্রেমিকের দুঃখকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলে।

৩. অপরাধী | আরমান আলিফ
যুগ পাল্টেছে। এখন আর প্রেমিকেরা দেবদাস হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে না। এখনকার প্রেমিকেরা একটু ত্যাদড় টাইপ। তারা কষ্ট পায়, মাঝেমাঝে সেটা মেজাজ দেখিয়ে প্রকাশ করে। আরমান আলিফের এই গান সেই জেনারেশনের প্রতিনিধিত্ব করে। আগের মত, আফসোস কিংবা প্রেমিকাকে মিনতি করা হচ্ছে না। তাকে সোজাসুজি বলা হচ্ছে ‘অপরাধী’। গানের কথাগুলো বেশ কড়া। ‘ও মাইয়া তুই অপরাধীরে, আমার যত্নে গড়া ভালোবাসা দে ফিরায়া দে...’। মানে হচ্ছে, তুমি যা করেছ, তার কোনো মাফ নেই। গিটার হাতে এক তরুণের এই গান হুট করে ভাইরাল হলো। কেন হলো? কারণ মানুষ নতুন কিছু চাইছিল। কান্নাকাটি অনেক হয়েছে। এবার একটু ব্লেম গেম খেলা যাক। বলাই বাহুল্য, গানটা প্রেমিকের মনোবলের জন্য ভালো। গানটা শুনলে একটা জেদ কাজ করে। মনে হয়, চলে গেছে তো কী হয়েছে? আমি তো আর মরে যাইনি। বরং সেই মেয়েটাই অপরাধী। সে আমার ভালোবাসা বোঝেনি। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার এবং প্রাক্তনকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য এই গানের কোনো বিকল্প নেই।

৪. মাধবী কি ছিল ভুল | আতিক হাসান
কিছু কিছু নাম আছে যা শুনলেই মনের ভেতর ঘণ্টা বেজে ওঠে। মাধবী তেমনই একটা নাম। আতিক হাসান যখন এই গানটা গাইলেন, তখন নিশ্চয়ই মাধবী নামের মেয়েরা বেশ বিপদে পড়েছিল। অন্যদিকে, আতিক হাসানের গলাটা খুব দরদী। তিনি যখন গানটা গান, মনে হয় তিনি নিজেই মাধবীর প্রেমে পড়েছিলেন। মাধবী তাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এই গানটা প্রচুর বেজেছে। ক্যাসেট প্লেয়ারে ফিতা জড়িয়ে যেত, তবুও মানুষ গানটা শুনত। কারণ এই গানে একটা মায়া আছে। একটা হাহাকার আছে। শুনলে মনে হয়, প্রেম বড়ই পিচ্ছিল। এখানে পা হড়কালেই বিপদ। মাধবীর মতো কেউ একজন আসবে, মন ভোলাবে, তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। রেখে যাবে একরাশ প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। মিলবে বলেও মনে হয় না।

৫. এত কষ্ট | হাসান
ব্যান্ডের গানেও যে বুক ফাটা কান্না থাকতে পারে, তার সেরা উদাহরণ এই গান। ‘আর্ক’ ব্যান্ডের হাসান। যার লম্বা চুল আর আকাশছোঁয়া হাই স্কেল। তিনি প্রশ্ন করলেন— ‘এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়?’ প্রশ্নটা সহজ। কিন্তু এর উত্তর মহাবিশ্বের কোথাও নেই। সৃষ্টির শুরু থেকেই ভালোবাসায় কষ্ট আছে। লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রোমিও-জুলিয়েট— সবার কপালেই জুটেছে কষ্ট। হাসান সেই চিরন্তন সত্যটাকেই গানে তুলে ধরলেন।

এত তীব্র আর্তনাদ! সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। যারা চিৎকার করে কাঁদতে পারছেন না, তারা এই গানটা ফুল ভলিউমে ছেড়ে দিন। হাসান আপনার হয়ে কেঁদে দেবেন।

৬. লাল শাড়ি | সোহাগ

বাঙালি প্রেমিকের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য কোনটা? প্রেমিকার গায়ে লাল বেনারসি শাড়ি। হাতে মেহেদি। কানে ভারী দুল। সে সেজেছে বউ কিন্তু অন্য কারো জন্য। সোহাগের এই গানটি সেই ট্র্যাজেডি নিয়ে। গানটি শুনলে চোখের সামনে একটা বিয়ের আসর ভেসে ওঠে। সানাই বাজছে। সবাই আনন্দ করছে। শুধু এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে এক হতভাগা প্রেমিক। তার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সে আর কোনোদিন প্রেমিকের কাছে ফিরবে না। সে এখন ‘পরের ঘরের ঘরণী’। সোহাগের গায়কিতে একটা গ্রাম্য টান আছে যা গানটাকে আরও বেশি আপন করে তোলে। মনে হয় ঘটনাটা পাশের গ্রামেই ঘটেছে। এই গানটি ‘ছ্যাকা খাওয়া’ প্রেমিকদের জন্য বিষের মতো। শুনলে কষ্ট বাড়ে। তবুও তাঁরা শোনে। কারণ মানুষ নিজের কষ্টের প্রতিচ্ছবি খুঁজতে পছন্দ করে।

ইউটিউব লিংক: Lal Shari Poriya Konna | লাল শাড়ী পরিয়া কন্যা | SHOHAG | Official Music Video | Bangla New Song 2020

৭. জানি একদিন | হৃদয় খান

প্রেমের সম্পর্কে একটা কমন ডায়লগ আছে: ‘আমি মরে গেলে বুঝবে’ কিংবা ‘আমি চলে গেলে বুঝবে’। এটা এক ধরণের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। হৃদয় খানের এই গানটা হলো সেই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের মিউজিক্যাল ভার্সন। গানটা খুব সফট। মেলোডিয়াস। কিন্তু কথাগুলো বেশ ভারী।

হৃদয় খানের সুরের জাদু গানটাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। খুব বেশি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নেই। শুধু পিয়ানো আর ভায়োলিনের করুণ সুর। সম্পর্ক যখন ভাঙার পথে, তখন এই গানটা খুব রিলেট করা যায়। শেষবারের মতো সম্পর্কটা জোড়া লাগানোর একটা আকুতি আছে এই গানে।

৮. কষ্ট | আইয়ুব বাচ্চু
কষ্ট আর আইয়ুব বাচ্চু— শব্দ দুটো সমার্থক। তিনি ছিলেন কষ্টের ফেরিওয়ালা। এলআরবি-র এই গানটি বাংলা রক মিউজিকের ইতিহাসে এক মাইলফলক। গানটার শুরুতেই বাচ্চু ভাই বলে দিচ্ছেন— ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’। কী অদ্ভুত কথা! মানুষ তো সুখ পেতে চায়। আনন্দ পেতে চায়। কিন্তু তিনি বলছেন উল্টো কথা। তিনি কষ্ট পেতে ভালোবাসেন। কেন? কারণ ‘তাই তোমার কাছে ছুটে আসি’। অর্থাৎ ভালোবাসার মানুষের কাছে গেলেই কষ্ট পাওয়া যায়। আর সেই কষ্টটাই তার প্রিয়। তিনি নীল রঙের বেদনা ভালোবাসেন। পাথরের মতো কান্না ভালোবাসেন।

আইয়ুব বাচ্চু আমাদের শিখিয়ে গেছেন, কষ্টেরও একটা সৌন্দর্য আছে। সেটাকে উপভোগ করতে জানতে হয়। ব্রেকআপের পর যখন মনে হয় জীবনটা অর্থহীন, তখন গানটা শুনুন। মনে হবে, এই কষ্টটাই তো জীবনের আসল স্বাদ। এটা না থাকলে জীবনের মানে কী?

অনারেবল মেনশন:
শিরোনামে বলেছিলাম ৮টা গান। বোনাস হিসেবে আরেকটা গানের কথা না বললেই নয়।

আর যাবো না বেগুন তুলিতে | নার্গিস
এতক্ষণ আমরা শুধু ছেলেদের কষ্টের কথা শুনলাম। গানগুলো সব ছেলেদের গাওয়া। মনে হতে পারে, প্রেমে শুধু ছেলেরাই ছ্যাকা খায়। মেয়েরা বুঝি ধোয়া তুলসী পাতা। তারা শুধু কষ্ট দেয়, কষ্ট পায় না। এই ধারণাটা ভুল। আর সেটা প্রমাণ করতেই এই গান। নার্গিসের গাওয়া এক কালজয়ী গান ‘আর যাবো না বেগুন তুলিতে...’। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটা কৃষি বিষয়ক গান; বেগুন তোলা নিয়ে গান। কিন্তু আসলে তা নয়। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক গভীর ট্র্যাজেডি। গ্রামবাংলার এক সহজ সরল মেয়ে। সে তার প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যেত বেগুন ক্ষেতে। কিন্তু প্রেমিক তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই ধোঁকা খাওয়ার পর মেয়েটি প্রতিজ্ঞা করছে, সে আর বেগুন তুলতে যাবে না। মানে সে আর প্রেম করতে যাবে না। মেয়েদের পার্স্পেক্টিভ থেকে গাওয়া এমন বিরহের গান খুব কমই আছে। গানটির সুর ফোক ঘরানার। কিন্তু এর আবেদন সর্বজনীন। শহরের এসি রুমে বসে থাকা মেয়েটিও এই গানের সাথে কানেক্ট করতে পারে। কারণ ধোঁকা খাওয়ার যন্ত্রণা সবখানেই এক। প্রেমের খেলায় নারী-পুরুষ উভয়েই সমান ভুক্তভোগী। কেউ জেতে না। সবাই হারে।

ইউটিউব লিংক: আর যাবো না বেগুন তুলিতে | Ar Jabo Na Begun Tulite | Nargis Gaan | Tiktok Viral | Bondhu Products

Ad 300x250

সম্পর্কিত